মানিকগঞ্জে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের দূর্নীতি পর্ব-২

জাহিদুল হক চন্দন
আপডেটঃ ২৫ জুন, ২০২৪ | ১০:০২
জাহিদুল হক চন্দন
আপডেটঃ ২৫ জুন, ২০২৪ | ১০:০২
Link Copied!

গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষবাণিজ্যের কারণে উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) পকেট ভরলেও ভোগান্তি বাড়ে জনগনের। গত চার মাস ধরে মানিকগঞ্জের ৫টি উপজেলায় সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে গ্রামীণ রাস্তাঘাট মেরামতকাজের দুরবস্থা এবং এলাকার মানুষের দুর্ভাগের করুণ চিত্র।

 

দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া ইউনিয়নের টেপরি এলাকার জরিমন বেগম। বয়স ৮০ পার করেছেন। তাঁর বাড়ির সামনের মাটির রাস্তা বছরখানেক ধরে ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি গেলেই বাড়ি ও আশপাশ ধুলায় ভরে যায়। ফলে প্রায় সময়ই জরিমন বেগমকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে হয়।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে জরিমন বেগম স্মৃতিচারন করে বলেন, ‘এক যুগে কতবার রাস্তাডা মেরামত অইলো, কিন্তু কামের কাম কিছুই অইলোনা। এ জীবনে একটাই চাওয়া রাস্তাডা জানি সুন্দর কইরা দেওন অয়, অসুস্থ অইলে জানি তাড়তাড়ি রাস্তা দিয়া হাসপাতালে যাইবার পাড়ি’।

একই এলাকার খোদেজা বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, গতবারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য লিটন এই রাস্তায় একবার মাটি ফেলেন। এবারের নির্বাচিত মফিজুল এই রাস্তার কাজ আবার করেন। তারও আগে আরকবার কাজ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তিনবার রাস্তার কাজ করতে দেখেছেন তিনি। রাস্তার উন্নয়নে আশেপাশের জমিওয়ালারা মাটি দিয়েছেন। তিনবারই অল্প অল্প মাটি ফেলা হয়েছে। তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে তা আবার ধুলার রাস্তায় পরিনত হয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে এ রাস্তায় এখন চলাচল করা কষ্টকর।

 

বিজ্ঞাপন

আরেক বাসিন্দা আদু মিয়া বলেন, ‘কোন রকমে আশেপাশের জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তায় দেওয়া হয়। ঠিকঠাকমতো মাটি দেওয়া হলে রাস্তাটি এতোদিনে আরো উঁচু হতো। কিন্তু রাস্তা যা তাই আছে। এসব রাস্তার কাজে কত টাকা আসে আর কত টাকা ব্যয় হয়, তা আমরা জানি না; জানতেও চাই না। শুধু রাস্তাটা ঠিকঠাক থাকলেই আমরা খুশি।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) সাধারন প্রথম পর্যায়ের আওতায় ‘টেপরি মাঠ হতে মাদুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ কাজে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে, এ প্রকল্পেও পিআইওর অনিয়মের ফলে রাস্তার কাজ ঠিকঠাক না হওয়ায় এলাকাবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে।

 

‘সেলিনা মেম্বারের বাড়ি হতে আফসার ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ কাজে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে টিআর নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। রাস্তাটি ঘুরে দেখার সময় কথা হয় সাবেক ইউপি সদস্য সেলিনা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, ৯-১০ বছর আগে তিনি ইউপি সদস্য থাকাকালে প্রথম এ রাস্তাটির প্রকল্প নেওয়া হয়। তারপর কয়েক বছর আগে লিটন মেম্বার আরো একটি প্রকল্প নেন।

 

‘এতো প্রকল্প নেওয়ার পরেও রাস্তাটি পুরোপুরি চলাচলের উপযোগী হচ্ছে না কেন’- এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

তবে রাস্তাটির বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আমিনা বেগম বলেন, কত বছর ধইরাই দেখতাছি রাস্তায় একটু একটু কইরা মাটি ফালান অয়। তয় এহনো রাস্তা দিয়া ভালোমতন চলন যায়না। রাস্তা বেশি ভালো না হওনে রিক্সা,ভ্যান এইদিকে আহেনা,হাইট্যা গিয়া গাড়িতে উঠন লাগে’।

 

এদিকে ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মফিজুল ইসলামের বাড়িতে প্রবেশের রাস্তাটিও বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ করা হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে টিআর সাধারন তৃতীয় পর্যায়ের আওতায় ‘আইয়ুবের বাড়ি হতে মফিজুল মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত’ রাস্তা মেরামত কাজে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৫৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে,  ইউপি সদস্য নিজে প্রকল্প সভাপতি হওয়ার পরেও পিআইওর ঘুষের রোষানলে পড়ে বরাদ্দের পূর্নাঙ্গ টাকা পাননি। ফলে ওই রাস্তা ব্যবহারকারীরা ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করছে।

এ রাস্তার বিষয়ে এলাকার বাসিন্দা রওশনারা বলেন, ‘রানিং মেম্বারের বাড়িতে যাওয়া আসার-রাস্তাতেও মাটি ফেলা হয়নি। বালু ফেলে রাস্তার সংস্কার কাজ করা হয়েছে। রাস্তার মাথাও বাঁকা। পাশে পুকুর থাকায় চেগার দেওয়া দরকার। নাহলে রাস্তাটি ধসে যেতে পারে। এ রাস্তায় বৃষ্টির দিনে চলাচলে ভোগান্তি বাড়ে।’

রিনা বেগম বলেন, রাস্তাটি খাড়াভাবে নির্মান হওয়ায় শিশুরা চলাচল করতে ভয় পায়। আমরা চাই রাস্তাটির বরাদ্দ বাড়িয়ে সুন্দরভাবে যেনো করা হয়।

এ রাস্তার বিষয়ে প্রকল্প সভাপতি ও ইউপি সদস্য মফিজুল ইসলাম বলেন, আমার ওয়ার্ডে আগের ইউপি সদস্যর চেয়ে সর্বোচ্চ কাজ করার চেষ্টা করছি। পিআইও অফিস যেভাবে দিকনির্দেশনা দেয়, সেভাবেই কাজ করি।

২০২২-২৩ অর্থ বছরে টিআর সাধারন প্রকল্পে ১ম পর্যায়ে জিয়নপুর ইউনিয়নের ‘পংতিরছা বেল্লালের বাড়ি হতে পশ্চিম পাড়া নতুন মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত কাজে ৯৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নতুন মসজিদের সামনে থেকে পুরাতন মসজিদ হয়ে রাস্তায় বালু ফেলে সংস্কার কাজ দেখানো হয়েছে। আর এসব বালু অবৈধ্ ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে তোলা হয়েছে। বালু ফেলে সংস্কার কাজ করায় বর্ষা মৌসুমে সড়কটি আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে জানিয়ে এলাকাবাসী মন্তব্য করেন, নদী থেকে বালু তোলায় প্রকল্প সভাপতির ড্রেজার আর শ্রমিক খরচ ছাড়া পুরোটাই লাভ। আর পিআইও নিজের পকেট আগেই ভরাতে রাস্তা টেকসই হলো, না জলে গেলো, তা দেখার প্রয়োজন মনে করেন না।

রাস্তাটির শেষ প্রান্ত বেল্লালের বাড়ির দোকানের সামনে গিয়ে জয়েন শেখ, কামরুল, নার্গিসসহ কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তারা জানান, ড্রেজার সরকার নিষিদ্ধ করেছে তা সবারই জানা। এসব ড্রেজারের ফলে নদীভাঙন দেখা দেয়। তবে রাস্তার জন্য ড্রেজার ব্যবহার করায় কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু রাস্তায় বালু ফেলায় তা বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে।

এ প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য সুফিয়া বেগম বলেন, পিআইও অফিস থেকে শুরু করে সকল কাজ চেয়ারম্যান তদারকি করেছেন।

ইউপি চেয়ারম্যান মো: বেলায়েত হোসেন বলেন, প্রকল্প তালিকা পাঠানোর পর পিআইও অফিস যাচাই বাছাই শেষে এসটিমেট করে দেয়। সেই অনুযায়ী কাজ করা হয়। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাটি ফেলতে হবে, এমন কোন নিয়ম নেই। তাই বালু ফেলে কাজ করা হয়েছে।

ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের কান্দাকুষ্টিয়া গ্রামের সাহেব আলীর বাড়ি হতে মহর আলীর বাড়ি পর্যন্ত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কাবিখা প্রকল্পের ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাস্তার মাটি ভরাটের কাজ পান পয়লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: হারুন-অর-রশীদ। অনুসন্ধান বলছে, প্রকল্পের কাজ যথা সময়ে শেষ করেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও সভাপতি। এই অনিয়মকে আড়াল করার জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নদীতে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। ওই প্রকল্পে মহর আলীর বাড়ি পর্যন্ত কাজ করার কথা থাকলেও ভরাট করা হয়েছে চান্নু বেপারীর দোকান পর্যন্ত। এছাড়া কাবিখা প্রকল্পের রাস্তার মাটি শ্রমিক দিয়ে ভরাট করার নিয়ম থাকলেও তা মানেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও সভাপতি। মাটির বদলে পাশের কালিগঙ্গা নদীতে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে মাটি ভরাট করা হয়েছে। এতে হুমকীর মুখে পড়েছে মানুষের বসতভিটা ও কৃষি জমি।

কান্দাকুষ্টিয়া গ্রামের মতিয়র রহমান বলেন, ভরাটের আগেই এই মাটির রাস্তার অবস্থা ভালো ছিল। এখন বালু দিয়ে ভরাটের কাজ করায় কোন গাড়ি চলতে পারে না।

একই গ্রামের জিল্লুর রহমান ও সোলায়মান  জানান, এই রাস্তার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২৫ লাখ টাকা। এখানে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকার বালু ভরাট করা হয়েছে কি না সন্দেহ। চেয়ারম্যান ও সরকারী অফিসাররা মিলে কিছু টাকার কাজ করে বাকি টাকা খেয়ে ফেলেছে। এ কারণে কাজ শেষ হওয়ার আগেই কয়েক জায়গায় ধসে গেছে। কাজ ঠিকঠাক না হওয়ায় জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে।

পয়লা ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার ওই প্রকল্পের সদস্য জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি হারুন-অর-রশীদকে কাজের অনিয়মের বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে ওই সময়ে দায়িত্বপালনকারী প্রকল্প ব্যস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিয়ম মাফিক সকল কাজ করা হয়েছে। আমার সময়ে কেউ অনিয়ম করার সুযোগ পাননি।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা মিতরা ইউনিয়নে টিআর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রথম পর্যায় এমপি কোটায় মিতরা ছাপড়া মসজিদ হতে মিতরা বাজার হয়ে মনিন্দ্রের বাড়ি হয়ে জরনার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জরনা বেগম, সাইদুর, শাহিনুরসহ এলাকাবাসীর দাবি, ছাপড়া মসজিদ থেকে জরনার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় কোনো কাজই হয়নি। ইটের সোলিংয়ের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা থাকার কারনে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়।

জানতে চাইলে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য মঞ্জুর আলম বলেন, কাগজে-কলমে তিনি সভাপতি হলেও কাজটি করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন।

মো. নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এমপি কোটায় কাজ করতে হলে একজন ইউপি সদস্যকে সভাপতি করতে হয়। কাজটি আমিই করেছি। তাকেও খরচাপাতি দিয়েছি। কত টাকার কাজ ছিল তা মনে করতে পারছি না। তবে অফিস খরচ দেওয়া হয়েছিলো ও অফিসের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা হয়েছে।’

ওই সময় দায়িত্বপালনকারী পিআইও বদলী হয়ে যাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এস এম সালেকুল আলম বলেন, বেতিলা মিতরা ইউনিয়নের প্রতিটি প্রকল্প পরিদর্শন করে বিল দেওয়া হয়েছে। একাধিক প্রকল্প থাকায় অনেক সময় জনবল সংকটের কারণে পুরো বিষয় নজরদারি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কোথাও অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠা ওই প্রকল্পে অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সার্বিক অনিয়ম ও জনগনের ভোগান্তির বিষয় তুলে ধরা হলে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত) মো:শামছুজ্জামান আসিফ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তার ব্যবস্থা গ্রহনের সুযোগ নেই। পিআইওদের এমন অনিয়মের বিষয়ে অধিদপ্তরকে জানানো হবে।

 

ট্যাগ: