তৃণমূলের উন্নয়ন প্রকল্পে ‘সাত ভূতে’ লুটপাট . যেনতেন কাজে জনগণের ভোগান্তি

জাহিদুল হক চন্দন
আপডেটঃ ৪ জুন, ২০২৪ | ৪:৪৭
জাহিদুল হক চন্দন
আপডেটঃ ৪ জুন, ২০২৪ | ৪:৪৭
Link Copied!

বাবা ও বড় ভাই- দুজনেই ছিলেন দুইবার করে নির্বাচিত ইউপি সদস্য। একে তো পারিবারিক ঐতিহ্য, তার ওপর এলাকাবাসীর চাপ- এই দুইয়ে মিলে ৫০ বছর বয়সে এসে মো. লুতফর রহমানকে কাঁধে নিতে হয় জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব। মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে তিনি প্রথমবারের মতো ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন ২০২১ সালে। সত্যিকারের জনকল্যাণের মনোভাব নিয়ে মাঠে নামেন লুতফর রহমান। কিন্তু শুরুতেই খেতে হয় হোঁচট। সেটা আবার অন্য কোথাও থেকে নয়; খোদ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় থেকে; যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। লুতফর রহমান হাতেনাতে প্রমাণ পেলেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার পর বিল তুলতে গিয়ে বরাদ্দের একটা অংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হয় পিআইওকে।

 

দৌলতপুর পিআইও কার্যালয় থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় জীবনের প্রথম যে উন্নয়ন কাজের সুযোগ পান লুতফর, সেটা হলো- ‘মূলকান্দি আফজালের বাড়ি থেকে নীল কমলের বাড়ির কাছে ইন্দরা পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ প্রকল্প। বরাদ্দ পান ৭০ হাজার টাকা। সততা ও নিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে প্রকল্প সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি। কাজ শুরুর জন্য প্রথম কিস্তিতে ৩৫ হাজার টাকাও বুঝে পান। কিন্তু কাজে নেমে দেখেন, ঠিকঠাকমতো কাজ করতে গেলে এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। পরে নিজের পকেটের এবং এলাকাবাসীর কাছ থেকে আরো ৮০ হাজার টাকা জোগাড় করে মোট দেড় লাখ টাকা দিয়ে রাস্তার কাজ শেষ করেন লুতফর মেম্বার। এরপর বরাদ্দের দ্বিতীয় কিস্তির ৩৫ হাজার টাকার বিল তুলতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। দৌলতপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো: মুমিনুর রহমান বিল দিতে টালবাহানা শুরু করেন। পরে ঘটনা বুঝতে পেরে লুতফর মেম্বার পিআইওকে ৭ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বাকি বিল তোলেন।

বিজ্ঞাপন

 

একই উপজেলার আরেক ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামের মুখেও একই রকম কথা শুনে দৈনিক টেলিগ্রাম সিদ্ধান্ত নেয় অনুসন্ধানের। গত চার মাস ধরে মানিকগঞ্জ জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে ৫টিতে অনুসন্ধান চালানো হয়। দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয়, সিংগাইর ও সদর উপজেলার মোট ৭৬টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার পর যে সত্য উঠে আসে, তা হলো- দেশের প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপজেলা পিআইও কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর যে বরাদ্দ দেয়, তার বড় একটি অংশই লুট হয়ে যায়। এই লুটপাটের গোড়াতেই থাকেন পিআইও স্বয়ং। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ ছাড়া তিনি কাজের বিল দিতে চান না। তাঁর দেখাদেখি পিআইও কার্যালয়ের অন্য স্টাফরাও আদায় করেন মাস্টাররোল তৈরির ‘হাদিয়া’। পরে আবার বিলের পিছে ঘুরতে গিয়ে যাওয়া-আসা, চা-নাস্তা-দুপুরের খাওয়ায় খরচ হয়ে যায় আরো কিছু টাকা। একসময় কোনো নিবেদিতপ্রাণ জনপ্রতিনিধিও টের পান, বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক টাকাই খেয়ে ফেলছে ‘সাত ভূতে’। তখন তাঁর ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ অবস্থা। অনেকের আবার আগে থেকেই স্বভাব নষ্ট- উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয়-এ সিদ্ধহস্ত। এভাবে চেয়ারম্যান, মেম্বার, প্রকল্প সভাপতি, প্রকল্প কমিটির সদস্যরা- সবাই মিলে জড়িয়ে যান টাকা লুটপাটে। চেয়ারম্যানকেও দিতে হয় বরাদ্দের অন্তত ৫ শতাংশ।

 

বিজ্ঞাপন

এই সব লুটপাটের প্রভাব গিয়ে পড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে। যেনতেনভাবে কাজটা সেরেই বিলের পিছে দৌড়ান মেম্বাররা। অনেক সময় আবার কোনো কাজ না করেই বিল তুলে লুটেপুটে খান সবাই মিলে। মাঝখান থেকে সরকার-প্রশাসন চালানোর সমস্ত খরচ যুগিয়েও উন্নয়নবঞ্চিত থেকে জীবনভর দুর্ভোগ পোহান জনগণ।

 

এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আমরা কথা বলি ১৪ জন প্রকল্প সভাপতির সাথে। প্রকল্পের বিল আনতে গিয়ে পিআইওকে ঘুষ দেওয়ার কথা এ প্রতিবেদকের কাছে অকপটে জানিয়েছেন তারা। আরো কথা বলেছি ৫টি উপজেলার ৩ জন পিআইওসহ তাঁদের কার্যালয়ের মোট ৫ জন স্টাফের সাথে। তাঁদের মধ্যে ৫ জন স্টাফ বলেছেন,পিআইও স্যারদের নির্দেশে সঠিকভাবে সকল কাজ করা হয়।। আর তিন জন পিআইও বলেছেন,অনিয়মের সাথে তারা জড়িত নন।

 

উপজেলা পিআইওর অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার হাতে। তাঁর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত সভায় মেম্বাররা চেয়ারম্যানের কাছে নিজ নিজ ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজের চাহিদা জানান। ইউপি সচিব সেগুলো নোট নিয়ে রেজুলুশন করিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও বরাবর পাঠিয়ে দেন। ইউএনও সেটা দেখে-বুঝে পাঠিয়ে দেন পিআইওর কাছে। পিআইও জেলা কর্নধার কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বাজেট বুঝে প্রকল্প তৈরি করে চেয়ারম্যানদের কাছে দেন। চেয়ারম্যানরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে সভাপতির নেতৃত্বে কাজ শুরু করিয়ে দেন। তার আগে জনগণের টাকার সদ্ব্যবহার করে জনগণের কল্যাণে সঠিকভাবে উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে পিআইও এবং প্রকল্প সভাপতির মধ্যে তিনশো টাকার স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

 

পাঠক, চলুন, দেখে আসি এই আপাত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার আড়ালে বাস্তবে কী ঘটছে তৃণমূল উন্নয়নের মাঠে।

 

ঘুষ ছাড়া বিল নাই

 

লুতফর রহমান এতোদিন কৃষি কাজ ও গরুর খামার করে মোটামোটি সচ্ছলভাবেই জীবনযাপন করছিলেন। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘ইউপি মেম্বার হিসেবে জীবনের প্রথম কাজটি সততার সাথে করার চেষ্টা করেছিলাম। নিজের পকেটের টাকা খরচ করেছি। এলাকাবাসীও সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ধাক্কা খেয়েছি কাজের বিল তুলতে গিয়ে।’ লুতফর রহমান বলেন, প্রথমে পিআইও মুমিনুর রহমানের কাছে যাই। তিনি বলেন, অফিসের স্টাফদের সাথে কথা বলে সবাই যেভাবে বিল নেয়, সেইভাবে আসেন। তখন স্টাফদের কাছে গেলে তারা বলে দেন, কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আপনাকে জানানো হবে। কিন্তু তারা আর কিছুই জানায় না। পরে আবার একদিন পিআইওর সাথে দেখা করতে গেলে স্টাফরা বাধা দিয়ে বলেন, স্যার ব্যস্ত আছেন; আরেকদিন আসেন। পরে আবারো একদিন যাই এবং একই কথা শুনে ফিরে আসতে হয়। এভাবে কয়েকদফা চেষ্টা করেও পিআইওর সাথে আর দেখা করা সম্ভব হয় না; বিলও পাই না।’ লুতফর বলেন, পরে স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পারি, এভাবে বিল হয় না; স্যারকে খুশি করতে হবে। পরে বাধ্য হয়ে রাজি হলে পিআইওর সাথে দেখা করার সুযোগ মেলে। প্রকল্পের কাজে নিজের ও গ্রামবাসীর ত্যাগের কথা জানিয়ে ঘুষ ছাড়া বিল প্রদানের অনুরোধ করলেও পিআইওর মন গলে না। বরং বলেন, কাজ ভালো হয়েছে বলেই অফিস খরচ কম ধরা হয়েছে। ওই অফিস খরচটা স্টাফদের কাছে দিয়ে বিল নেওয়ার পরামর্শ দেন পিআইও। পরে স্টাফরা জানান, পিআইও সাত হাজার টাকা অফিস খরচ দিতে বলেছেন।’ লুতফর মেম্বার  বলেন, ততদিনে আমি বুঝে গেছি, এই ঘুষ না দিলে পদে পদে হয়রানি হতে হবে। তাই সাত হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ৩৫ হাজার টাকার বিল তুলি।’

 

 

 

একই উপজেলার খলসী ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে টিআর ৩য় পর্যায়ে (সাধারন) প্রকল্পে পারমাস্তুল আব্বাসের বাড়ি হতে খাজুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত প্রকল্পে ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের সভাপতি করা হয় ৭, ৮ ও ৯ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হাজেরা বেগমকে। এদিকে আবার খাজুর বাড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে  ‘পারমাস্তুল তারিকুলের বাড়ি হতে আওলাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ নামের প্রকল্পে ১ম পর্যায়ে ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের সভাপতি ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম। হাজেরা বেগম যে প্রকল্পের সভাপতি ওই প্রকল্পেও নজরুল ইসলাম প্রকল্প কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথম প্রকল্পটিতে বেশিরভাগ মাটি রাস্তার দুইপাশের ডোবা থেকে কেটে রাস্তায় ফেলে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু জায়গায় বালু দিয়ে কাজ করায় টেকসই হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পে আশপাশের ব্যক্তি মালিকাধীন জায়গা থেকে মাটি নিয়ে কোনোমতে মেরামত কাজ করা হয়েছে।

 

এ দুটি প্রকল্প ঘুরে দেখার সময় মেম্বার নজরুল ইসলামের সাথে দেখা হয়ে যায়। পরে তিনিই দুটি রাস্তার সংস্কার কাজের বর্ননা দেন। ঠিকমতো কাজ করেননি কেন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কাগজে কলমে যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তাতো আর পাওয়া যায় না। প্রথম প্রকল্পে ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ বরাদ্দ হলেও প্রকল্প সভাপতি হাজেরা বেগম পুরো টাকার কাজ করতে পারেননি। পিআইওকে ঘুষ ও অফিস স্টাফদেরকে মাস্টার রোলের নামে হাদিয়া দেওয়ার পর যে টাকা ছিল, তার সঠিক ব্যয় করেছেন। দ্বিতীয় প্রকল্পের বেলায়ও তাই করেছি।’

 

এ দুটি প্রকল্পে পিআইও অফিসে কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে জানতে চাইলে নজরুল বলেন, ‘পুরোপুরি মনে নাই, তবে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

 

নজরুল মেম্বার আরো বলেন, প্রকল্পের কাজগুলো নানা জটিলতায় শতভাগ সম্পন্ন করা যায় না। কারণ, একজন ইউপি সদস্যের বেতন সরকারি অংশ ৩৬০০ টাকা আর ইউনিয়ন পরিষদের অংশ ৪৪০০ টাকা- মোট ৮ হাজার টাকা। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে আলাদা করে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। ফলে প্রকল্প সভাপতিরা কিছু অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এ সুযোগটাও নিয়ে থাকেন পিআইও।’

 

২০২২-২৩ অর্থ বছরে কাবিখা প্রকল্পে নতুন ধামশ্বর আবুল হাসেমের বাড়ি হতে চান মিয়ার বাড়ি পয়ন্ত রাস্তা মেরামতে ৪ মেট্রিক টন গম; খলসী নারচী-শ্যামগঞ্জ পাকা রাস্তা খলসী ছায়েদের বাড়ি হতে নরুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণে ৫ টন গম; কলিয়া তালুকনগর বিলপাড়া আরমেধেরে বাড়ি হতে ৩ নং প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত রাস্তা পুণ:নির্মাণে ৫ টন, বাঘুটিয়া বাশাইল জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে মাটি ভরাট ৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ হয়। তবে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব কাজের অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি।

 

জিয়নপুর ইউপির সদস্য সবুর উদ্দিন বলেন, এসব প্রকল্পে সরকারি রেটে গম বা চালের রেটের অর্ধেক টাকা পাওয়া যায়। এছাড়া অফিসিয়াল নানাবিধ কাজে টাকা ব্যয় হয়ে যায়।

 

কলিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য গৌরাঙ্গ সাহা বলেন, ‘প্রকল্পের শুরুতে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা দিয়ে কাজ শুরু করি। কাজ শেষ করে বাকি টাকা আনতে গেলে লাখে ১০ থেকে ১৫ হাজার ঘুষ না দিলে বিল পাওয়া যায় না। আমরাও বাধ্য হয়ে ঘুষ দিই; তখন পিআইও কোনো ঝামেলা করেন না। এটা একটা রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। এই ঘুষের কারণে পূর্নাঙ্গ কাজ করা সম্ভব হয় না। এজন্য অনেক সময় এলাকার মানুষের কথা শুনতে হয়। ঘুষ না দিলে বিল পাই না, এদিকে ঠিকমতো কাজ না করলে পাবলিকের কথা শুনতে হয়। আমরা আছি বিপদে।’

 

এভাবে প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারি ইউপির সদস্য ফজলাল ফকির, বাচামারা ইউপির সদস্য মো: গোলাম মোস্তফা সরদার, বাঘুটিয়া ইউপির সদস্য মো: আবু বক্কর সিদ্দিক, ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিন বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মো. মুনসের বিশ্বাস, শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো: মুন্নাফ মিয়া, সিংগাইর উপজেলার জামশা ইউনিয়ন সদস্য শহিদুল ইসলাম অকপটে জানান পিআইওকে ঘুষ আর তাঁর অফিসের স্টাফদেরকে ‘হাদিয়া’ দেওয়ার কথা।

 

কলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভাতা একেবারেই কম। এছাড়া প্রকল্প সভাপতিদের আলাদা যাতায়াত ভাতা থাকে না। ফলে প্রকল্পের বরাদ্দ থেকেই অনেকে এসব খরচ মিটিয়ে থাকেন। পিআইওর খরচ তো আছেই। এছাড়া মাস্টাররোল পিআইও অফিসের কর্মচারীদের দিয়েই করানো হয় বলে তাদেরকে প্রতি লাখে পনেরো শ টাকা দিতে হয়।

 

রাস্তা এক, প্রকল্প দুই

 

২০২২-২৩ অর্থবছরে দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া ইউনিয়নের পাঁ‘চথুরি পাকা রাস্তার হাসেম মেম্বারের বাড়ি হতে অজের আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ কাজে ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই অর্থ বছরেই নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক টিআর প্রকল্পে ‘পাঁচথুবি হাসেম মিয়ার বাড়ি হতে উত্তর পাড়া মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ কাজে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার নাম দুটি ভিন্ন হলেও মূলত একটাই রাস্তা। একই অর্থ বছরে একই রাস্তায় দুটি প্রকল্প মিলিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তেমন কাজ হয়নি।

 

ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুইপাশের জমি কেটে মাটি তুলে রাস্তাটি উঁচু করা হয়েছে। সৌরভ, আয়নাল, মজনুসহ একাধিক গ্রামবাসী জানান, রাস্তার পাশে ব্যক্তি মালিকাধীন জায়গা হওয়ার পরেও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে সবাই মাটি দিয়েছে; সরকারকে মাটি কিনতে হয়নি। তারা আরো জানান, ভেকু দিয়ে মাটি কেটে রাস্তায় ফেলা হয়েছে।

 

তাহলে কি শুধু ভেকুর খরচ ৯০ হাজার টাকা? এমন প্রশ্নে প্রকল্প সভাপতি মো: রিপন মিয়া বলেন,  ভেকু দিয়ে পুরো কাজ করতে পারিনি। পরে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছি।’ তিনি বলেন, নানান সংকটে পড়ে নিয়মমাফিক কাজ না হওয়ায় পিআইও ঘুষের জন্য বার বার চাপ দিয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে দুটি প্রকল্প থেকে পিআইওকে মোট ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছি।’

 

ভুতুড়ে প্রকল্প

 

২০২১-২২ অর্থবছরে টিআর কর্মসূচির আওতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নে বরুরিয়া গ্রামে ‘বরুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর মাঠ ভরাট করতে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক লাখ টাকা। কাগজপত্রে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে টাকাও তুলে নেওয়া হয়। অথচ সরেজমিন অনুসন্ধানে বরুরিয়া গ্রামে ওই নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। ঘিওর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার পারভীনও বলেন, উপজেলায় এ নামের কোনো স্কুল নেই।

 

একই অর্থবছরে টিআর প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ‘বরুরিয়া সর্বজনীন মহাশ্মশানঘাট’ সংস্কারের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। একইভাবে অনুসন্ধানে ওই নামে কোনো শ্মশানঘাটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

 

ওই দুই অর্থ বছরে দায়িত্বপালনকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) বর্তমানে কর্মরত আছেন কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, বড়বিলা নামের জায়গায় বররিয়া হওয়ায় বিষয়টি প্রিন্টিং মিসটেক হয়েছে। পরে সংশোধন করে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর উতকোচ নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। চেয়ারম্যান –মেম্বাররা বাড়তি সুবিধা না পেলেই অভিযোগ করে। মাস্টার রোল যারা করে দেয় তাদের পরিশ্রম হয় তাই তারা পরিশ্রম বাবদ পারিশ্রমিক নিয়ে থাকতে পারেন।

দৌলতপুর পিআইও কার্যালয়ের ওয়ার্ক এসিস্ট্যান্ট মানিক চন্দ্র রায় বলেন, প্রতিটি প্রকল্প স্টিমেট অনুযায়ী শেষ হলে সকল প্রকল্পই পরির্দশন করা হয়। আমি ও পিআইও স্যার দুজন মিলে এসকল প্রকল্প পরিদর্শন করি। ঠিকঠাক কাজ না হলে পিআইও স্যার বিল দেন না। আর আমি কোন টাকা পয়সা নেই না।

দৌলতপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ( পিআইও) মো: মুমিনুর রহমান বলেন, প্রতিটি প্রকল্প শতভাগ শেষ হওয়ার পর বিল পরিশোধ করা হয়। প্রকল্প থেকে ঘুষ নেওয়ার কথা সত্য নয়। যারা বলেছেন মিথ্যা বলেছেন।

 

শিবালয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ( পিআইও) সুদেব কৃষ্ণ এ বিষয়ে মুঠোফোনে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

 

ওই দুই অর্থ বছরে সিংগাইর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার ( পিআইও) আবু নাছের বর্তমানে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। তবে তিনি হজ্ব পালন করতে দেশের বাইরে ছুটিতে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে হিসাব নিয়ে জানা যায়, দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয় ও সিংগাইর- এই ৪টি উপজেলার ৪ জন পিআইওর কাছে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার তিনশো ৭৯ টি প্রকল্পে মোট ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৪৬ হাজার তিনশো ৪৬ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। অনুসন্ধানমতে, এর মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকাই ঢুকেছে ওই চার পিআইওর পকেটে।

 

পিআইওদের এসব অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারান্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটির সাথেই অফিসের কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু চেয়ারম্যান মেম্বারদের যোগসাজশ থাকায় অনিয়ম সংগঠিত হয়। এসব অনিয়মের ফলে উন্নয়ন বঞ্চিত হয় সাধারন মানুষ। যারা এমন অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। এছাড়া চুক্তি ভিত্তিক এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো উচিত।

 

এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত) মো:শামছুজ্জামান আসিফ বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ সকল অভিযোগের বিষয়ে ত্রাণ ও পুর্নবাসন অধিদপ্তরকে জানাবো।

ট্যাগ: