মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন

মাছুম বিল্লাহ
আপডেটঃ ২ জানুয়ারি, ২০২২ | ৯:০৮
মাছুম বিল্লাহ
আপডেটঃ ২ জানুয়ারি, ২০২২ | ৯:০৮
Link Copied!

করোনা মহামারি আমাদের অনেক ঐতিহ্য ভেঙে দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো ফেব্রুয়ারি মাসে; কিন্তু মহামারির কারণে ২০২১ সালের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় নভেম্বর মাসে। ২০২০ সালের মার্চে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বর্তমান এসএসসি পরীক্ষার্থীরা মাত্র আড়াই মাস সময় পেয়েছিল শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা গ্রহণ করতে। অনলাইনে যদিও কিছুটা হয়েছে; কিন্তু পুরো তো হয়নি। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার পর দেড় মাস শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করে তারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। অন্যান্য বছরের মতো এবার সব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। শুধু গ্রুপভিত্তিক-বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার তিনটি বিষয়ে সময় ও নম্বর কমিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পাবলিক পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়। এটি মন্দের ভালো-কারণ ‘অটোপাশে’ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান কারোই তৃপ্তির কোনো জায়গা থাকে না। এবার অন্য আবশ্যিক বিষয় ও চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। এসব বিষয়ে জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ‘ম্যাপিং’ করে নম্বর দেওয়া হয় এবং এগুলোর ভিত্তিতেই এসএসসি ও সমমানের ফল ঘোষণা করা হয়।

করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২১ সালে নয় মাস পিছিয়ে গত ১৪ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়, শেষ হয় ২৩ নভেম্বর। সেটা ছিল দেড় বছর পর প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষা। ২০২১ সালে এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মাধ্যমিকে আংশিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ৫৪৪ দিন টানা স্কুল বন্ধ থাকায় মাধ্যমিকের সব বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। একই কারণে আগেই কমানো হয়েছিল মাধ্যমিকের সিলেবাসও। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, সারা দেশের ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পরীক্ষার্থীই পাশ করতে পারেনি, আবার এর বিপরীতে ৫ হাজার ৪৯৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাশের হার শতভাগ। গত বছর ১০৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাশ করেনি, সে তুলনায় বিষয়টি ভালো বলা যাবে। তবে একজন শিক্ষার্থীও যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতকার্য হয়নি, তাদের ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এগুলো কি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান নাকি নন-এমপিও? এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হলে অবশ্যই জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে প্রতিষ্ঠান প্রশাসনকে। তবে এখানে একটি দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটি হলো-মাউশিরই দায়িত্ব ছিল জাতিকে জানানো যে, এ প্রতিষ্ঠানগুলো কোন ধরনের। কারা কারা এখানে পড়িয়েছেন, কীভাবে পড়িয়েছেন-পুরো বিষয়গুলো নিয়ে মাউশির উচিত জাতির সামনে তা উপস্থাপন করা, যাতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই মিলে এসব প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করার জন্য সরকারি-বেসরকারি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আছেন। তাদের সঙ্গে শুধু সমন্বয় দরকার। দেখা যাবে, মাউশি কিংবা মন্ত্রণালয়ের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা হয়তো প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জানব, জানতে পারব না শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার শিক্ষার্থী, সব বোর্ড মিলে এ সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৭ জন, সব বোর্ড মিলে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। এবার এসএসসি পরীক্ষায় নয়টি সাধারণে শিক্ষা বোর্ডে গড়ে পাশ করেছে ৯৪ দশমিক ০৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। গতবার এ হার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সব ধরনের বোর্ড মিলে এ হার ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন। তার মানে, পরীক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৪ জন। নয়টি সাধারণ বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৭ হাজার ৬৭৬টি বিদ্যালয়ের ১৮ লাখ ৯৯৮ শিক্ষার্থী এবং ৯ হাজার ১১০টি মাদ্রাসার ৩ লাখ ১ হাজার ৮৮৭ জন শিক্ষার্থী। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষায় অংশ নেয় ২ হাজার ৩৪৯টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ২৪ হাজার ২২৮ জন শিক্ষার্থী। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৩০১ জন ছাত্রী অংশ নেয়, তাদের মধ্যে পাশ কেরছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৮ জন, আর অকৃতকার্য হয়েছে ৬০ হাজার ৩৮৩ জন। পাশের হার ৯৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। ছাত্র অংশ নেয় ১১ লাখ ৪২ হাজার ৯৪ জন এবং পাশ করে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৮ জন। অকৃতকার্য হয়েছে ৮৩ হাজার ৪৬৬ জন। পশের হার ৯২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

আগে সাধারণত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বড় নিয়ামক হিসাবে দেখা হতো তুলনামূলক কঠিন বলে পরিচিত ইংরেজি ও গণিতকে। কিন্তু এবার বাধ্যতামূলক এসব বিষয় এবং চতুর্থ বিষয়ে কোনো পরীক্ষা হয়নি। তবে বাংলা ও ইংরেজি হচ্ছে বেসিক বিষয়, এ দুটির পরীক্ষা ছাড়া কিন্তু মূল্যায়ন করা কঠিন। ভাষার জ্ঞান না থাকলে কোনো বিষয়েই ভালো করা যায় না। ভাষা হচ্ছে সঠিক যোগাযোগের, কোনোকিছু বোঝার এবং বোঝানোর মাধ্যম। সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা গ্রহণের সময়ই বড় বড় শিক্ষাবিদরা বলেছিলেন, এ দুটি বেসিক বিষয়ের পরীক্ষা না হওয়া মানে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। কঠিন বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়া, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুসরণ এবং বিষয় সংখ্যা কমানোর কারণেই এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার অনেক বেশি। প্রশ্নপত্রে বিকল্প অনেক বেশি ছিল, এটিও একটি কারণ। ‘কাজেই এ ভালো মানে এত ভালো হয়ে গেছে-এ সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। সবকিছু নির্ভর করবে অতিমারির পরের অবস্থার ওপর।’ মন্তব্যটি করেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। তার সঙ্গে আমি একমত পোষণ করছি।

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার পরও ৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এবার অকৃতকার্য হয়েছে। এর পেছনের একটি কারণ হতে পারে এমসিকিউতে অকৃতকার্যতা। প্রতিটি বিষয়ে সিকিউ (সৃজনশীল) ও এমসিকিউতে ফেল করা। এ ছাড়া কিছু শিক্ষার্থী সিকিউ অংশে পাশ করতে পারেনি। এটি আরেকটি বড় দুর্বলতা। আমাদের তরুণ ও স্মার্ট শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে; কিন্তু মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষাদান পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে তাদের সুপ্ত সৃজনশীল প্রতিভা চাপাই পড়ে থাকে। শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও মূল্যায়নের কারণেই ফল এত ভালো হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো একরকম হবে না; কিন্তু এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে যাতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান না থাকে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান হাজার বৈষম্যের মধ্যে এটি অন্যতম। মানসম্মত শিক্ষার কথা আমরা সবসময়ই বলে থাকি। কিন্তু বিষয়টি আসলে কী সে সম্পর্কে আলোচনা হওয়া দরকার। একজন শিক্ষার্থী তার নিজ পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে পারবে, নিজ পাঠ্যপুস্তকে যা যা শিখেছে সেগুলো বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবে, তাদের চিন্তন দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, তাদের কমিউনিকেশন বা যোগাযোগের দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় থাকবে। সঠিকভাবে ভাষা ব্যবহার করতে পারবে-এগুলোর সমন্বিত রূপই হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। একইভাবে শিক্ষকদেরও ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত হতে হবে, শিক্ষা বিজ্ঞানের জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে, সেভাবে শিক্ষার্থী ডিলিং করতে জানতে হবে, শিক্ষার্থীদের ভেতর জ্ঞানের পিপাসা জাগ্রত করার কৌশল জানতে হবে, নিজের উপস্থাপন দক্ষতা হতে হবে আকর্ষণীয়, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে এবং এর ব্যবহার জানতে হবে। একজন শিক্ষার্থী প্রচলিত নিয়মে হয়তো তার দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেনি; কিন্তু তার অন্তর্নিহিত দক্ষতা একজন শিক্ষককে আবিষ্কার করতে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী তাকে গাইড ও মূল্যায়ন করার দক্ষতা ও কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সেটিই কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়ন।

বিজ্ঞাপন

মাছুম বিল্লাহ : সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবি শিক্ষক

masumbillah65@gmail.com

ট্যাগ: