মানিকগঞ্জে মন্দিরের চালে জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাশীলদের থাবা

বিশেষ প্রতিবেদক
আপডেটঃ ৫ অক্টোবর, ২০২২ | ১১:০৫
বিশেষ প্রতিবেদক
আপডেটঃ ৫ অক্টোবর, ২০২২ | ১১:০৫
Link Copied!

দুর্গাপূজা উপলক্ষে মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলায় ৫৪৮টি মন্দিরে সরকারি বরাদ্দের (জিআর) ২৭৪ মেট্রিক টন চালের বিপরীতে অর্থ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। সরকারিভাবে এসব চালের দর ৪০ টাকা কেজি হলেও জেলার সবকটি উপজেলায় মন্দির কর্তৃপক্ষকে ২৮ টাকা থেকে ৩১ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করতে বাধ্য করেছে এসব সিন্ডিকেট। এতে মন্দিরের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এসব চক্র।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কতিপয় নেতা-কর্মীরা এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সদর উপজেলায় সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কবির হোসেন ও যুবলীগ নেতা  তারেক খান। তাঁরা স্থানীয় খাদ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে মন্দির কমিটি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছেন।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৬৫টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় ৫৪৮টি মন্দিরে এবার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও সরকারিভাবে মন্দির কমিটিগুলোকে সহায়তা করা হয়েছে। প্রতি মন্দিরে ৫০০ কেজি করে চালের চাহিদাপত্র (ডিও) উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ি এসব চাহিদাপত্রের বিপরীতে মন্দিরগুলোর কমিটিকে চাল দেওয়ার কথা। অথচ সবকটি উপজেলায় চাল ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যরা চাপে ফেলে মন্দির কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে কম মূল্যে এসব চাল কিনে নিচ্ছেন। এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন। এই আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত।

বিজ্ঞাপন

গত রোববার (২ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে দৌলতপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই কর্মকর্তার কক্ষে এক কর্মচারী বিভিন্ন মন্দির কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষর নিচ্ছেন। কক্ষে চেয়ারে বসে এক তরুণ একটি সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষকে ১৪ হাজার টাকা করে দিচ্ছেন।

কথা বলে জানা গেলো, দৌলতপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতোয়ার রহমান সিন্ডিকেট করে সরকারি মূল্য থেকে ১২ টাকা করে কম দিচ্ছেন। ওই তরুণ ছাত্রলীগ নেতার প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে এই দায়িত্ব পালন করছেন।

মান্দারতা পূর্বপাড়া সার্বজনীন দূর্গামন্দিরের সভাপতি উপেন্দ্র মণ্ডল বলেন, বাধ্য হয়েই তাঁদেরকে সিন্ডিকেটের কাছে কম মূল্যে চাল বিক্রি করা হয়।

বিজ্ঞাপন

ছাত্রলীগের নেতা আতোয়ার রহমান বলেন, ভৌগলিক কারণে এ উপজেলায় চালের দাম কম হওয়ায় মন্দির কমিটিকে কম দেওয়া হয়েছে।

দৌলতপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘মন্দির কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় চাল বিক্রি করে দিচ্ছেন। এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’

গত শনিবার (১ সেপ্টেম্বর) প্রতিটি মন্দির কমিটির কাছে উপজেলা পরিষদের মিলনায়তনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং খাদ্য নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতিতে সরকারি বরাদের চালের ডিও বিতরণ করা হয়।

সদর উপজেলার উচুটিয়া কর্মকারপাড়া সার্বজনীন পূজামণ্টপ কমিটির সভাপতি বাদল কর্মকার বলেন, ডিওতে তাঁর সাক্ষর নিয়ে প্রতি কেজি ৩১ টাকা দরে ৫০০ কেজি চাল বাবদ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের কারণে বাজার দরের চেয়ে কম মূল্যে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলায় সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কবির হোসেন ও যুবলীগ নেতা  তারেক খান। কবির হোসেন দাবি করেন, মন্দির কমিটির কেউ চাল নিচ্ছেন, কেউ বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাজার দরের চেয়ে তাঁদের কম মূল্য দেওয়া হচ্ছে না।

জেলার ১০টি মন্দির কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে ডিওতে মন্দির কর্তৃপক্ষের সাক্ষর নেওয়া হয়। এরপর মন্দির কমিটিকে চাল কেনার সিন্ডিকেট চক্রের কম দামে চাল কিনছেন। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা সরকারি মূল্যের ৪০ টাকার বদলে গড়ে ৩০ টাকা কেজি হিসেবে মন্দির কমিটিকে দিয়ে বাকি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই সিন্ডিকেটে সরকারি গুদামের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অনির্বাণ পাল বলেন, জেলায় ৫৪৮টি মন্দিরে ৫০০ কেজি করে মোট ২৭৪ মেট্রিক টন (২ লাখ ৭৪ হাজার কেজি) চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়। মন্দিরগুলোর কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের কাছে বাজার দরের চেয়ে গড়ে ১০ টাকা করে কম দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সেই হিসেবে জেলায় ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতি বছরই এই আর্থিক অনিয়ম হয়ে আসছে। প্রশাসনকে এ বিষয়ে জানালেও কোনো সুফেল মিলছে না।

এসব বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শেখ রিয়াদ কামাল বলেন, ‘চাল বিতরণ করা আমাদের দায়িত্ব। তবে মন্দির কমিটি কারো কাছে চাল বিক্রি করলে এটা আমাদের দায়িত্ব নয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের (খাদ্যগুদামের) কেউ জড়িত থাকার সুযোগ নেই।’

 

ট্যাগ: