‘লড়াইটা মেসি-এমবাপ্পের নয়, ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার’

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৫:০১
ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৫:০১
Link Copied!

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে কাল সন্ধ্যাটা আর্জেন্টিনার জন্য ছিল আবেগের। কিন্তু সেই আবেগের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি লিওনেল মেসি, আনহেল দি মারিয়া, হুলিয়ান আলভারেজদের চেহারায়। বরং তাঁরা সবাই মন দিয়েই অনুশীলনটা করলেন। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে শেষ অনুশীলন সেশন, নতুন ইতিহাস গড়ার চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি—মন দিয়েই তো সবকিছু করতে হবে তাঁদের। কিন্তু গোটা আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়েরা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই কাটালেন। ভেতরের রোমাঞ্চটা তাঁরা বুঝতেই দিলেন না। যেন বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাঁরা খেলতে নামেন।

খেলোয়াড়দের মধ্যে খেলা নিয়ে উত্তেজনাটা একটু কমই থাকে। সাধারণ একজন দর্শকের চেয়ে সেটি অনেক কমই। দর্শকেরা গ্যালারিতে বসে বা টেলিভিশনের সামনে যেভাবে উত্তেজনায় টগবগ করেন, খেলোয়াড়দের মধ্য সেটি থাকলে তো তাঁরা ঠিকভাবে খেলতেই পারবেন না! তেমন কিছু খেলোয়াড়দের মধ্য থাকবে না, সেটিই স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলে বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে উত্তেজনা থাকবে না! অবশ্যই থাকবে, সে জন্য তো আর উপলক্ষটা ভেস্তে দিতে পারেন না তাঁরা। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাত নিয়ে তাঁরা তো বাকিটা জীবন স্মৃতিচারণা করবেন। প্রৌঢ়ত্বের সীমায় বসে নাতি–নাতনিদের সে গল্পগুলো করবেন। সেখানে না হয় আগের রাতের আনন্দগুলোও থাকুক।
বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে মেসির কেমন লাগছে! স্বপ্ন ছোঁয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুভূতিটা নিশ্চয়ই অন্য রকম। ক্যারিয়ারে সম্ভব–অসম্ভব প্রায় সব শিরোপাই জিতেছেন। সাতবার জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। চ্যাম্পিয়নস লিগ একাধিকবার। এর বাইরে ব্যক্তিগত অজস্র পুরস্কার। আর্জেন্টিনা দলের হয়েই গত বছরের আগপর্যন্ত তিনি কিছুই জিততে পারেননি। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ব্রাজিলে কোপা আমেরিকা ট্রফিটা ২৮ বছর পর নিজের করে নিয়েছে আর্জেন্টিনা। মেসিও যেন এর মাধ্যমে আর্জেন্টিনার আকাশি–নীল জার্সিতে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ট্রফির খুব কাছ দিয়ে ঘুরে এসেছিলেন, সেটি হাত দিয়ে ছোঁয়া হয়নি। এর বাইরে খেলেছিলেন আরও তিনটি বিশ্বকাপ, সেগুলোতে সর্বোচ্চ কোয়ার্টার ফাইনালই ছিল আর্জেন্টিনার দৌড়। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপের পর তো আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিলেন। জাতীয় দলের জার্সিটি যেন প্রচণ্ড চাপ হয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই তারকাকে। মেসি তারপরও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে এসেছেন অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে—শেষটা রাঙাবেন বিশ্বকাপ জিতে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কাল কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে মেসির নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল সব কথা। আজ ফ্রান্সকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা যদি বিশ্বকাপ জিততে চায়, তাহলে মেসিকেই যে জ্বলে উঠতে হবে।
আনহেল দি মারিয়া ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালটা খেলতে পারেননি। চোটের কারণে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটিই হারিয়েছিলেন বলে মনে করা হতো। সেদিন জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালটা যদি দি মারিয়া খেলতে পারতেন, তাহলে আর্জেন্টিনা হয়তো ভিন্ন কিছু করতেও পারত—এমন বিশ্বাস অনেক আর্জেন্টিনা সমর্থকেরই। ২০১৮ বিশ্বকাপে এই ফ্রান্সের বিপক্ষেই দূরপাল্লার শটে অসাধারণ এক গোল করেছিলেন আর্জেন্টিনার এই কিংবদন্তি।
ক্যারিয়ারের বড় অংশ কাটিয়েছেন মেসির ছায়ার আড়ালে। এবারের বিশ্বকাপেও যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, নিজেকে উজাড়ই করে দিয়েছেন। চোটের কারণে কোয়ার্টার ফাইনাল পুরোটা খেলতে পারেননি। সেমিতে কেন যেন তাঁকে মাঠেই নামাননি কোচ লিওনেল স্কালোনি। আজ ফ্রান্সের বিপক্ষে দি মারিয়ার খেলতে পারাটা হবে নিজের ক্যারিয়ারের বিরাট এক মুহূর্ত। মেসির মতো এটাও হয়তো আর্জেন্টিনার হয়ে হতে যাচ্ছে তাঁর শেষ ম্যাচ। এমন একটা ক্ষণ সামনে রেখে দি মারিয়াও নিশ্চয়ই দারুণ রোমাঞ্চিত। মনটা কেমন নেচে নেচে উঠছে তাঁর। হয়তো ভাবছেন, শেষটা যদি রাঙানো যেত বিশ্বকাপ ট্রফির সোনালি আভায়!
কোচ লিওনেল স্কালোনিকে সেভাবে কে চিনত! চেনা ছিলেন তাঁর সহকারী পাবলো আইমার। স্কালোনি আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার আগে কেইবা সেভাবে খবর নিয়েছেন যে ২০০৬ বিশ্বকাপে মেসির সতীর্থ ছিলেন তিনি। ফুটবলার হিসেবে নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিতে না পারলেও আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে এরই মধ্যেই তিনি স্মরণীয় করে ফেলেছেন নিজেকে। তাঁর হাত ধরেই আর্জেন্টিনা ১৯৯৩ সালের পর আন্তর্জাতিক ট্রফির খরা কাটিয়েছে গত বছর কোপা জিতে। এরপর জিতেছেন লা ফিনালিসিমা। এবার স্কালোনির সামনে বিশ্বকাপ। তিনি কী পারবেন সিজার লুইস মেনোত্তি কিংবা কার্লোস বিলার্দোর জুতোয় পা গলাতে! আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ হিসেবে ইতিহাস গড়তে?
কাল কাতার বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তিনি সৌম্য চেহারায় দলকে নিয়ে কাজ করেছেন। কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো ভয়ংকর খেলোয়াড়কে সামলাতে স্কালোনি আলাদা করেই পরিকল্পনা আঁটছেন। সেই পরিকল্পনা যাঁকে করতে হয়, তাঁকে খুব ঠান্ডা থাকতে হয়। রোমাঞ্চ–টোমাঞ্চ নিয়ে ভাবার অত সময় তাঁর নেই। কিন্তু একটু হলেও কি তাঁর বুকে আলোড়ন ওঠেনি! আর একটি ম্যাচ জিতলেই তিনি হয়ে যাবেন আর্জেন্টিনার ফুটবলের অনন্য এক ইতিহাস। ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা হয়নি, কোচ হিসেবে সেই ভাগ্য তাঁর কি হবে! আইমার বড় তারকা ছিলেন স্কালোনির তুলনায়। এ শতকের শুরুতে আকাশি–নীল জার্সিধারীদের বড় তারকা, আর্জেন্টিনার রাশি রাশি নতুন ম্যারাডোনার একজন তিনিও। সহকারী কোচ হিসেবে তিনিও যে ইতিহাসের অংশ হওয়ারই দ্বারে দাঁড়িয়ে।
বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে ভাবনা, মনে মনে দুশ্চিন্তা, ইতিহাসের অংশ হওয়ার রোমাঞ্চ—সবকিছু একপাশে রেখে আর্জেন্টিনা অনুশীলনের মাঠটিকে উদ্‌যাপনের উপলক্ষই বানিয়েছিল কাল। অনুশীলন শেষে গোটা স্কোয়াড আলোকচিত্রীর সামনে দাঁড়াল। সবার মুখে হাসি, উচ্ছ্বলতা। বিশ্বকাপ জেতা, না জেতা পরের ব্যাপার। ছবিটি যেন বলে দিচ্ছে, ফাইনালটাই আর্জেন্টিনা দলের সদস্যদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ। বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার সৌভাগ্য সবার হয় নাকি!
এমন মেজাজই যে ফ্রান্সের বিপক্ষে আজকের ফাইনালে আর্জেন্টিনার খুব প্রয়োজন। ৩৬ বছরের খরা ঘোচাতে ফাইনালকে উপলক্ষ বানানোর বিকল্প যে আর নেই!
 

ট্যাগ: