২ কোটি টাকায় দফারফার অভিযোগ

ঢাকা ও খুলনায় দুই প্রকৌশলীর সম্পদের পাহাড়

দুদক দিয়েছে দায়মুক্তি!

নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেটঃ ১১ অক্টোবর, ২০২২ | ৫:৫৪
নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেটঃ ১১ অক্টোবর, ২০২২ | ৫:৫৪
Link Copied!

অবাক হবার মত ঘটনা হলেও সত্য যে পাহাড় সমান অবৈধ সম্পদ দৃশ্যমান থাকলেও গণপূর্ত অধিদপ্তর ও সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের দুই প্রকৌশলীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

আর এ জন্য দুই প্রকৌশলীর ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর এলাকাবাসী দুদকের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের ভাষ্য: দুদক কি তবে দায়মুক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ? এ বিষয়ে একটি রিভিউ আবেদন করেছেন একজন সচেতন নাগরিক। তিনি মনে করেন যে, দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে এই দায়মুক্তি দিয়েছেন।

অভিযোগ অনুসন্ধানে জানাগেছে, এই দুই প্রকৌশলীর নাম প্রদীপ কুমার বসু ও তার স্ত্রী প্রকৌশলী তাপসী বিশ্বাস। প্রদীপ কুমার বসু গণপূর্ত অধিদপ্তরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে চাকুরীরত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। অন্যদিকে তার স্ত্রী তাপসী বিশ্বাস সড়ক ও জনপথ বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন। বর্তমানে তার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ জেলায়। চাকুরী জীবনে তারা দুজনেই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা ও অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। সে সব সম্পদ এখনো দৃশ্যমান রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

খুলনার বয়রা এলাকায় প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসুর ১০ কাঠা জমির ওপর মার্কেট।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, প্রদীপ কুমার বসু গণপূর্ত অধিদপ্তরের গুরুতপূর্ণ বিভাগ, জোন ও সর্বশেষ প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনেরে সুযোগে নিয়ে ঘুস, দুর্নীতি ও প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা এবং গোল্ডেন মনিরের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। তাকে নোটিশ করে তলবান্তে বক্তব্য নেওয়া হয়। অপরদিকে তিনি গোপালগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ ফজিলাতুননিসা চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্বে থাকা কালে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেন।

খুলনা দুদক কার্যালয়ে প্রকৌশলী তাপসী বিশ্বাস

এ বিষয়ে প্রধান মন্ত্রীর দপ্তর ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের হলে সেটি তদন্ত করে তাকে দোষী সাব্যস্থ করা হয়। এজন্য তিনি বিভাগীয় শাস্তিও পান। পরবর্তীতে নানা মহলে তদবীর করে তিনি সেই বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি পান এবং গণপূর্তের সাবেক সচিবকে ম্যানেজ করে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। কেবল পদোন্নতিই নয়, তিনি ঢাকা মেট্রো জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদায়িত হন।এখানে বসেও তিনি তার অধিনস্ত ১৪ জন নির্বার্হী প্রকৌশলীর কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

চাকুরী জীবনে বেসুমার অনিয়ম দুর্নীতি করায় তিনি যে সকল বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্ত ও দন্ডিত হয়েছেন সেগুলো হলো: বরিশাল গণপূর্ত জোন স্মারক নং ৭-৮২/৪৩২ তারিখ: ১৩/০৩/২০১২ ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং ২৫.০০.০০০০.০১৩.৯৯.০০৯.১৬.৭৯ তারিখ: ২৩/০৬/২০১৬ ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং-২৫.০১৮.০০৫.০০২.০০.০২১.২০১৬./৪৪৬ তারিখ: ১৫/১২/২০১৬ ইং। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্মারক নং ০৫.০০.০০০০.১৭৪.২২.০০২.১৮-৫৬ তারিখ: ২১/০৫/২০১৯ ইং।

বিজ্ঞাপন

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং ২৫.০০.০০০০.০১৩.৯৯.০২২.-১৬.৬৪২ তারিখ : ২৬/০৬/২০১৯ ইং। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গোপালগঞ্জ গণপূর্ত সার্কেল স্মারক নং ২৫.৩৬.৩৫০০.১০০.০৯.১৩১৮ তারিখ : ০২/০১/২০২০ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং-২৫.০০.০০০০.০১৮.২৭.০০৭.১৯.-১৮৬ তারিখ: ২৪/০৮/২০২০ইং।

দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় স্মারক নং -০০.০১.০০০০.৫০১.০১.১৩০.১৮ তারিখ: ০১/১২/২০২০ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং-২৫.০০.০০০০.০১৮.২৭.০১২.২০.৩১৫ তারিখ: ২৫/১১/২০২০ইং। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) পরিপত্র ০৯/০৩/২০০৮ ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং-২৫.০০.০০০০.০১৩.০১২.০০৬.১৭-১১২ তারিখ: ১৯/০৮/২০১৮ ইং। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্মারক নং-২৫.০০.০০০০.০১৩.১২.০০১.১৭-১৪৭ তারিখ: ০৮/১১/২০১৮ ইং। বর্তমানে তিনি দুদকের প্রধান কার্যালয়ের অধিকতর তদন্তে রয়েছেন। যার স্মারক নং ০০.০১.০০০০.৫০১.০১.০১০.২২/১৬০৪৫ তাং ২৫/০৪/২০২২ ইং।

এভাবে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকার বয়রা এলাকায় ১০ কাঠা জমি ক্রয় করেছেন যার বর্তমান বাজার মুল্য ১০ কোটি টাকা। এই জমির ৫ কাঠা তার নামে এবং ৫ কাঠা তার স্ত্রী তাপসী বিশ্বাসের নামে দলিল করা হয়েছে। এই ১০ কাঠা জমির ওপর তিনি বহুতলা শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই দোতলা অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। এই শপিং কমপ্লেক্স তৈরী করতে ৮০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।

এ ছাড়াও তিনি ঢাকা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে ঢালি বাড়ী রোডে আলীশান একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। এই ফ্ল্যাটের মূল্য কমপক্ষে ২ কোটি টাকা। ফ্ল্যাটে আসবাসপত্র আছে আরো ২/৩ কোটি টাকার। প্রদীপ বসু তার বোন অঞ্জলী দাসকে খুলনায় একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েনে যার মূল্য কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা। এছাড়া ভারতেও তিনি প্রচুর সম্পদ করেছেন বলে শোনা যায়। একখানা প্রাইভেট গাড়ী আছে যার নং ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৫৮৭৫। গাড়ীখানার মুল্য ৫৫ লক্ষ টাকা।

এদিকে তার স্ত্রী তাপসী বিশ্বাসের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানাগেছে, তিনি এখন সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন। তার বর্তমান কর্মস্থল গোপালগঞ্জ জেলা। তিনিও সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন সার্কেল ও জোনে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শত কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তিনি খুলনা শহরে প্রেস ক্লাবের সামনে ১০ তলা বিশিষ্ট একটি আলীশান বাড়ী নির্মান করেছেন। এই বাড়ীর বর্তমান মুল্য ৩০/৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বয়রাতে তার স্বামীর সাথে ৫ কাঠা জমি কিনেছেন যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকা।

তার বাবার বাড়ী তেরখাদায় আলীশান বাড়ী ও মন্দির নির্মাণ করেছেন। যার মুল্য কয়েক কোটি টাকা। তার আরেক ভাই মুক্তি দাসকে দিয়ে তার সকল অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তার খুলনার বাড়ীর পাশেই তার বোন লিপি দাসকে একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। যার মুল্য কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা। বাবা,মা,ভাই, বোন ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের নামেও প্রচুর সম্পদ করেছেন। ভারতে তার ভাই দেবদাস এর নামে প্রচুর জমি ক্রয় ও বাড়ী নির্মাণ করেছেন।

দুর্নীতির দায়ে ২০১২ সালে তিনি চাকুরী থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে রাজনৈতিক তদবীরে চাকুরী ফিরে পান। ২০১৮ সালে তার এই সম্পদের বিষয়ে নড়াইলের একজন ঠিকাদার দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করলে সেটি তদন্ত করে ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ৫৩ হাজার ৪৬৬ টাকার অবৈধ সম্পদের সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশন। এ বিষয়ে উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে রমনা থানায় দুদক আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করেন যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুছ ছাদাত। কিন্তু মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দায়মুক্তি মিলে যায়। প্রকৌশলী তাপসী বিশ্বাসের অবৈধ সম্পদ খুলনা শহরে দৃশ্যমান থাকলেও তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় দুদকের ওপর থেকে খুলনাবাসীর আস্থাই উঠে যায়। এ ছাড়া ভারতেও তাপসী বিশ্বাসের বাড়ী ও মার্কেট আছে বলে শোনা যাচ্ছে। দুদুক যদি এ বিষয়টি পুন: অনুসন্ধান করে তবে তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে এটা নিশ্চিত এমটিই মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য অবসরে যাওয়া অতি: প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ বসু উল্লেখিত সম্পদ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের যে সম্পদ আছে তা সবই বৈধ। ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে সবই উল্লেখ আছে এবং সরকারকে যথাযথ আয়কর দেওয়া আছে। দুদকের অনুসন্ধান সম্পর্কে বলেন, এটা আমাদের পারিবারিক দ্বন্দে¦র কারণে হয়েছে। আমি জবাব দিয়েছি। দেখা যাক কি হয়।

তার স্ত্রী তাপসী বিশ্বাস বলেন, চাকুরী জীবনে তিনি কোন অসৎ পথ অবলম্বন করেন নি। যা বেতন পেয়েছেন আর কিছু আত্মীয় স্বজনের ধারে তিনি বাড়িটা করেছেন। মার্কেটের জমিও আজ থেকে ১৫ বছর আগে কেনা বলে তিনি দাবী করেন। দুদকের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি প্রসংগে তিনি বলেন, দুদক তদন্ত করে আমার সব কাগজপত্র সঠিক পেয়েই দায়মুক্তি দিয়েছে।

তবে প্রকৌশলী প্রদীপ বসু ও তাপসী বিশ্বাসের এসব বক্তব্য সমর্থন করেননি এলাকার সচেতন মহল। তারা দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, দুদক যদি আবার পুন: অনুসন্ধান করে তবে তারা দুজনেই ফেঁসে যাবেন। এ ক্ষেত্রে তারা দুদক চেয়ারম্যানের পদক্ষেপ কামনা করেছেন।

 

ট্যাগ: