আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে মানিকগঞ্জের ‘দরগা’

Spread the love

জাহিদুল হক চন্দন

মানিকগঞ্জ শহরের হিজুলি এলাকায় ৫২ হাজার ইট দিয়ে তৈরি ওয়াসি মহল বা দরগায় নেই কোন জানালা। তারপরও চাঁদ আর সূর্যের আলো মুগ্ধতা ছড়ায় দিনরাত। জানালাবিহীন দরগার চারদিকে সবুজ গাছপালা। সেই গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে লাল ইটের ২৪ ফুট উচ্চতার একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী ফুটে উঠেছে নান্দনিক কারুকাজে। দরগাটিতে ধর্মীয় চর্চায় আগত ভক্তবৃন্দের সাথে চোখ জুড়াতে আসেন শত শত দর্শনার্থী। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এ স্থাপত্যের সুনাম ছড়িয়েছে বিদেশে।

স্থাপনাটি নিয়ে পড়ানো হচ্ছে ইতালির ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরেন্সে। বিশ্বের একাধিক নামী জার্নালে স্থাপনা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৪ সালে স্থাপত্যে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার রিবা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স পেয়েছে এ দরগাহ বা সমাধি। এ প্রকল্পের জন্য এর আগে ২০২৩ সালে ইউনিয়ন অব ইন্টারন্যাশনাল আর্কিটেক্টসের ফ্রেন্ডলি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ স্পেস পুরস্কার পেয়েছিলেন দরগার স্থপতি মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া এই স্থাপনা নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ এরিখ মেন্ডেলসন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতায় ব্রিক আর্কিটেকচার শ্রেণিতে মনোনীত হয়েছিলেন তিনি । 

স্থানীয়রা জানান, মানিকগঞ্জ শহরটিতে ঐতিহাসিকভাবেই সুফি, দরবেশ বা পীর প্রভাব বিস্তার করে এসেছেন। পেশায় কলেজশিক্ষক শাহ মোহাম্মদ মহসিন খানও তাঁদের মতোই একজন আলেম, যিনি ইসলামি দর্শনে উদ্বুদ্ধু করেছেন সেখানকার হাজারো মানুষকে। এটিই শাহ মোহাম্মদ মহসিন খানের দরগাহ বা সমাধিসৌধ। স্থানীয়ভাবে এটি ‘ওয়াসি মহল’ নামে বেশি পরিচিত। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শাহ মোহাম্মদ মহসিন খান, তাঁর স্ত্রী বেগম নূরজাহান ও বাবা মো. ইসমাইল খান।

এই দরগার স্থপতি মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ দুই দশক ধরে স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন। ২০০৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন ‘স্থাপতিক’ প্রতিষ্ঠানটি। স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন আহ্‌ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির স্থাপত্য বিভাগে।

মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাট দিয়ে প্লাস্টিক তৈরি করে আলোড়ন ফেলা বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান এ দরগাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন। ছোটবেলার এক বন্ধুর মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয়। এই বিজ্ঞানীই তাঁর বাবা মহসিন খানের স্মৃতি ও কর্মকে উজ্জীবিত রাখতে একটি পারিবারিক সমাধিসৌধ তৈরির ইচ্ছার কথা জানান। সমাধিসৌধটি সুলতানি আমলের মসজিদ ও দরগাহ, যেমন বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বা নয় গম্বুজ মসজিদের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত। এই স্থাপনার নকশা করার সময় এ রকম বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে প্রায় তিন মাস পড়াশোনা করেছি। আমি এখানে আলো নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করতে চেয়েছি। সাম্প্রতিক কালে আলো নিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ করেছেন লুই আই কান। আমাদের সংসদ ভবনে যে আলোর খেল, এটা একটা অন্য মাত্রার কাজ। আমাদের দেশে মেরিনা তাবাশ্যুম, কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর বানানো স্থাপত্যে চমৎকার আলোছায়ার খেলা দেখা যায়। এই সবকিছু থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার কাজটা করতে চেয়েছি।

জানা গেছে, শাহ মোহাম্মদ মহসিন খান দরগাহটি তৈরি হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে। এই দরগাহটি তৈরির সব কারিগর ও উপাদান স্থানীয়। ইটের কারুকাজের শিল্পী পাওয়া দুষ্কর হওয়ার পরও স্থানীয় কারিগরদের দুই সপ্তাহ ধরে এ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজটা বের করে আনা হয়েছে।

দরগাহর ভেতরের দিকে ওপরের ছাদ থেকে নেমে এসেছে সিলিন্ডার আকৃতির ১৬টি ঝুলন্ত কাঠামো বা ড্রপিংস। এসব সিলিন্ডারের নাম রাখা হয়েছে  বেহেশতের ঝাড়বাতি বা ‘শ্যান্ডেলিয়ার অব প্যারাডাইস’। ঠিক এই ঝাড়বাতিগুলোর নিচেই রয়েছে সাদা মার্বেল পাথরে গড়া ৩টি কবর। যেন আসমান থেকে স্বর্গীয় আলো সিলিন্ডারগুলোর ভেতর দিয়ে এসে পড়ছে সেই সমাধির ওপর।

অর্ধগোলাকৃতির দেয়ালগুলো তৈরি হয়েছে স্থানীয় পলিমাটি দিয়ে তৈরি ইটে। ভেতরের গরম বাতাস যাতে ওপর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে, যে জন্য ইটের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে চতুর্ভুজ আকৃতির ছোট ছোট ছিদ্র। প্রবেশদ্বারগুলো সর্বসাধারণের জন্য খোলাই থাকে। সেদিক দিয়ে রয়েছে শীতল বাতাসের অবাধ চলাচল। এই দরজাগুলোতেও রয়েছে নকশাদার পাঞ্চ, যাতে দরজা বন্ধ থাকলেও প্রাকৃতিক আলো–বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারে।

বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমেদ খান জানান, তার বাবা শাহ মুহাম্মদ মুহসীন খান ওয়াইয়েছিয়া তরিকার একজন সুফি সাধক ছিলেন। মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার মৃত্যুর পর স্বপ্ন ছিল বাবার কবরে একটি দরগা নির্মাণ করবেন। যেটা হবে ইউনিক। যার সঙ্গে বিশ্বের অন্য কোনো স্থাপনার মিল থাকবে না। ভাইবোনদের সহযোগিতায় বাবা-মা ও দাদার সমাধিক্ষেত্রে দরগাটি করতে পেরে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। বুকে বিশাল একটা প্রশান্তি। ওনাদের জন্য কিছু করতে পেরেছি। কারণ ওনারা সারাজীবন আমাদের জন্য করে গেছেন।

Scroll to Top