গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হইয়াছে, গ্যাস-সংকটের কারণে গত ৯ মাস ধরিয়া বন্ধ রহিয়াছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদন। ইহাতে প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ মেট্রিক টন উৎপাদনক্ষমতা হিসাবে প্রায় ৩ লক্ষ টন ইউরিয়া সার উৎপাদন ব্যাহত হইয়াছে। ইহার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরিয়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই সারকারখানাটি বন্ধ থাকায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাইতেছে লাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি ইহার অব্যবহৃত যন্ত্রাংশ মরিচা ধরিয়া ব্যাপক ক্ষতি হইবার আশঙ্কা দেখা দিয়াছে। আবার বেতনকাঠামো লইয়া কারখানাটির শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরিয়া বিরাজ করিতেছে অসন্তোষ। তবে এই মুহূর্তে কারখানাটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চালু রাখা জরুরি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইত্তেফাককে জানাইয়াছেন যে, গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার জন্য পেট্রোবাংলার কর্তৃপক্ষের নিকট যোগাযোগ করা হইতেছে। আমরা আশা করি, সারকারখানাটিতে গ্যাস সরবরাহ করিয়া পুনরায় উৎপাদন শুরুর ব্যাপারে শীঘ্রই কার্যকর উদ্যোগ লওয়া হইবে।
উল্লেখ্য, উৎপাদনরত অবস্থায় গত পহেলা মার্চ আশুগঞ্জ সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করিয়া দেয় বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। ইহার ফলে প্রতিদিন যেই পরিমাণ ইউরিয়া সার উৎপাদন ব্যাহত হইতেছে, তাহার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এই কারখানাটিতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখিতে প্রতিদিন প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। গুণমানসম্পন্ন হওয়ায় বাজারে আশুগঞ্জ সারকারখানার ইউরিয়া সারের চাহিদা বেশি। এইখানে প্রিলড ইউরিয়া সার উৎপাদিত হয় বলিয়া জানা যায়। তাই কারখানাটি চালু রাখিতে পারিলে সরকারেরই লাভ হইবে; কিন্তু একটি কুচক্রী মহল বিদেশ হইতে সার আমদানির মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য করিতে বৎসরের অধিকাংশ সময় আশুগঞ্জ সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখে বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে। এইখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, আশুগঞ্জ সারকারখানা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃক পরিচালিত। ইহা চালু করা হয় ১৯৮১ সালে; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস রেশনিংয়ের কারণে প্রতি বৎসর কারখানার উৎপাদন প্রায় পাঁচ-ছয় মাস বন্ধ রাখিতে হয়। এই বৎসর ৯ মাস বন্ধ থাকাটা দুঃখজনক। ইহা দেশে সারসংকটকে আরো ত্বরান্বিত করিতে পারে। তাহা ছাড়া দীর্ঘকাল এই ধরনের কারখানা বন্ধ থাকিলে সৃষ্ট করশোনের কারণে কারখানার প্রায় ছোট-বড় সকল ইক্যুইপমেন্ট/ মেশিনারিজ/ ভেসেলের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। ইহাতে কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন কার্যক্রম বিঘ্নিত হয় এবং কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় অর্জন করা সম্ভব হয় না। তাই এই বিষয়টি লইয়া সংশ্লিষ্ট বোর্ড অব ডিরেক্টরসে আলাপ-আলোচনা করিয়া অবিলম্বে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সারের বিপুল চাহিদা রহিয়াছে; কিন্তু এই চাহিদা মূলত আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। গ্যাসস্বল্পতার কারণে কিছু ইউরিয়া সারকারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় সারের সংকট আরো বৃদ্ধি পায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে দেখা দেয় কৃত্রিম সংকটও। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, বাংলাদেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা রহিয়াছে প্রায় ৭০ লক্ষ টন। ইহার ৮০ শতাংশ আমদানি করিতে হয়। উৎপাদন ও সরবরাহ লইয়া সংকটের কারণে ইহার সুযোগ গ্রহণ করে একটি অসাধু চক্র। তাহাদের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা বাড়তি মূল্যে সার কিনিতে বাধ্য হয়। অনেক সময় টাকা দিয়াও সার পাওয়া যায় না। এই বৎসর আমন মৌসুমে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সারের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৯৫ সালে সারের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলন করিলে তাহাদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ইহাতে ১৮ জন নিরীহ কৃষক প্রাণ হারান। কৃষকদের এমন আত্মাহুতি প্রদানের দৃষ্টান্ত থাকিলেও সারসংকটের স্থায়ী সমাধান না হওয়াটা দুঃখজনক। বস্তুত, আশুগঞ্জ সারকারখানার বিদ্যমান সমস্যাগুলি আশু সমাধানের দাবি রাখে।

