জ্যামাইকার আকাশে এখনো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে মেলিসার আর্তনাদ। ঘণ্টায় প্রায় তিনশ কিলোমিটার বেগে ধাবমান বাতাস, চার মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস, ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত জনপদ- সব মিলাইয়া যেন এক বিশালাকৃতি দৈত্য প্রবল আক্রোশে সকল কিছু লন্ডভন্ড করিয়াছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ের এই তান্ডব কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নহে, বরং ইহা এক প্রতীকী বিষয়ও বটে। আর তাহা হইল- প্রকৃতি ঘন ঘন ক্রুদ্ধ হইতেছে, আর মানুষ এখনো তাহার সেই ক্রোধের ভাষা বুঝিতে চাহিতেছে না।
কেহ কেহ ইহাকে ‘দুর্ভাগ্য’ বলিয়া ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু সত্য যাহা, তাহা আরো গভীরে। প্রকৃতি কখনো হঠাৎ করিয়া প্রতিশোধ লয় না; সে ধৈর্যের সঙ্গে দেখিতে থাকে মানুষ তাহার সহিত কেমন আচরণ করিতেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা যেইভাবে পৃথিবীর বুকে তান্ডব চালাইতেছি- জলবায়ু, বন, জীববৈচিত্র্য, মাটি ও নদীর প্রতি যে নির্মম অবজ্ঞা প্রদর্শন করিতেছি- সেই কর্মকাণ্ডই সুদে-আসলে আমাদের ফেরত দিতেছে প্রকৃতি। এইজন্য মেলিসা কেবল জ্যামাইকার নহে; পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের নিকট এক পরোক্ষ বার্তা। শিল্পবিপ্লবের পর মানবসভ্যতা যখন ‘অগ্রগতি’ নামক এক আলেয়ার পিছনে ছুটিতে শুরু করিল, তখনই এই বিপর্যয়ের বীজ রোপিত হইল। কয়লার ধোঁয়া, প্লাস্টিকের বর্জ্য, মুনাফার লোভে বৃক্ষনিধন- সব মিলাইয়া আমরা নিজেরাই বানাইয়াছি এমন এক পৃথিবী, যাহা ক্রমে আমাদের প্রতিপক্ষ হইয়া উঠিতেছে।
প্রকৃতির ক্ষতি কেবল বাহিরে সীমাবদ্ধ নহে; ইহা ধীরে ধীরে মানুষের মনোজগতেও প্রবেশ করিতেছে। জলবায়ুর উষ্ণতার সঙ্গে মানুষের মস্তিস্কের উত্তাপও বাড়িতেছে। যেইভাবে সমুদ্র এখন অশান্ত, তেমনি সমাজও ক্রমে অস্থির। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, সমাজে বিভাজন, ঘরে ঘরে হিংসা- সবই যেন এক অনিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণিঝড়, যাহার উৎস প্রকৃতির নহে, মানুষের অন্তরেরই গভীরে।
এই দুই বিপর্যয়- একটি প্রকৃতির, একটি মানুষের- আজ একে অপরের প্রতিবিম্ব হইয়া উঠিয়াছে। পৃথিবীর যেই অংশে মেলিসা আঘাত হানে, সেইখানে ঘর ভাঙে, মানুষ সহায়সম্বল কিংবা প্রাণ হারায়; আর পৃথিবীর যেই অংশে নৈতিকতা লুপ্ত হয়, সেইখানে মনুষ্যত্ব ভাঙে, আত্মা হারায়। উভয়ের ফল এক- ধ্বংস। অথচ ইতিহাসে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক ছিল সহাবস্থানের। মানুষ শিখিয়াছিল প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান, শিখিয়াছিল মিতব্যয়িতা। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই সম্পর্কটি পরিণত হইয়াছে চরম বৈরিতায়। আজকের মানুষ প্রকৃতিকে কাঁচামাল মনে করে, নদীকে ডাম্পিং সাইট ভাবে, গাছকে কাঠের মজুদ বলিয়া বিবেচনা করে। কিন্তু এই ভোগসর্বস্ব মনোবৃত্তিরই প্রতিফলন ঘটিতেছে সমাজের রাজনীতি ও নীতির স্তরে। রাষ্ট্রসম‚হ এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত, শিল্পকারখানাসম‚হ মানুষের চাহিদাকে পণ্যে রূপান্তর করিতেছে, আর ব্যক্তি হারাইতেছে নিজের সংযম ও বোধ।
এই কারণে জ্যামাইকার ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব আমাদের কেবল জলবায়ুর বাস্তবতা শেখায় না- ইহা শেখায় আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন মেরু অঞ্চলের বরফ গলিতেছে, তেমনি সভ্যতার অভ্যন্তরে গলিতেছে মানবিকতার বরফ। এই দুই স্রোত যখন মিলিত হয়, তখন সৃষ্টি হয় এক ভয়ংকর যুগ- যেইখানে আকাশ ঝড় তোলে, আর মানুষ অস্ত্র তোলে।
তাহা হইলে করণীয় কী? প্রথমত, বুঝিতে হইবে- প্রকৃতি ও মানবসমাজ আলাদা নহে। যেই সমাজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, সেই সমাজ নিজেরই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে। একইভাবে রাষ্ট্রসম‚হ যদি নিজেদের ক্ষমতার ভারে হিতাহিত জ্ঞানশ‚ন্য হয়, নাগরিকেরা যদি কেবল স্বার্থপরতা আর নীতিহীনতায় মত্ত থাকে, তবে মেলিসার মতো ঘূর্ণিঝড় কেবল একটি জনপদে নহে- সভ্যতার বুকে বারংবার আঘাত হানিবে।
এইজন্য মেলিসা কেবল একটি ঘূর্ণিঝড় নহে, ইহা এক প্রতীক- মানুষের উন্মত্ততার, প্রকৃতির প্রতিশোধের, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিণতির। এই পৃথিবী বাঁচাইবার দায়িত্ব কোনো রাষ্ট্রনেতার একার নহে; ইহা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, যখন প্রকৃতি ও মানুষ- উভয়েই ক্রুদ্ধ হয়, তখন আর নির্দিষ্ট কেহ বিজয়ী থাকে না।

