সম্প্রতি রাজনৈতিক দলের সহিত সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনি প্রচারণায় লাগানো পোস্টার সরাইয়া নেওয়ার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের পর অর্ধমাস অতিবাহিত হইতে চলিল; কিন্তু ইহার বাস্তবায়ন সেইভাবে পরিলক্ষিত হইতেছে না। এখনো রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর-নগর নির্বাচনি প্রচারণার পোস্টারে ছাইয়া আছে। মেট্রোরেলের পিলার হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন রাস্তাঘাট, সড়কের আইল্যান্ড ও দেওয়ালে পোস্টার লাগাইয়া ইসির অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া ও আইন ভাঙিয়া চলিতেছে নির্বাচনি প্রচারণা। ইহার পূর্বে নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়া নির্বাচনি আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন; কিন্তু কে শোনে কাহার কথা! বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মীদের নামে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন এখনো ঝুলিতেছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হইল, যাহারা খুব শিগগিরই জাতীয় সংসদে বসিবেন এবং আইন প্রণয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন, সেই ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্যদের একাংশ প্রকাশ্যে আইন অমান্য করিতেছেন। এমনকি একজনের উপর আরেক জনের পোস্টার ও জায়গা দখলের প্রতিযোগিতাও লক্ষণীয়। অর্থাৎ পোস্টার সাঁটানোর সেই পুরোনা সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান। অথচ দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২-এর ধারা-৪-এ বলা হইয়াছে যে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে; কিন্তু একই আইনের ধারা-৩-এ আরো বলা হইয়াছে যে, ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না। যদি কেহ এই আইন ভঙ্গ করে, তাহা হইলে তাহার বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে। অর্থদণ্ড অনাদায়ে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড হইতে পারে। ইহার পাশাপাশি ঐ ব্যক্তিকে তাহার নিজের খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার নির্দেশও দেওয়া যাইবে।
এইদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে কোনো পোস্টারই ব্যবহার করা যাইবে না। এই বার বিলবোর্ডে প্রচারের অনুমতি থাকিবে। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করিতে পারিবেন। শুধু তাহাই নহে, শহর-নগরের সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানেও আইন রহিয়াছে; কিন্তু সেই আইনেরও প্রয়োগ সঠিকভাবে হইতেছে না।
উল্লেখ্য, নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দেড় লক্ষ জরিমানা এবং দলের জন্য দেড় লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হইয়াছে। প্রয়োজনে তদন্ত সাপেক্ষে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও রহিয়াছে ইসির। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি কার্যকর হইবে শিডিউল (তপশিল) ঘোষণার পর হইতে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। শিডিউল ঘোষণার পরও যদি রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা পোস্টার না সরায়, তাহা হইলে নির্বাচন কমিশন নিজেরাই তাহা অপসারণ করিবে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, আইন প্রয়োগ ছাড়া লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করিয়া পোস্টার সরানো কোনো স্থায়ী সমাধান নহে। জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান কার্যকর করা হইলে অন্যরা তাহা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিবে। ইহা ছাড়া যেই হারে পোস্টার অপসারণ চলিতেছে, তাহাও পর্যাপ্ত নহে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক চলতি মাসের শুরুর দিকে জানান যে, এক মাসে তাহারা প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করিয়াছেন। এই অনুযায়ী যেই খরচ হইয়াছে তাহা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে আদায় করা প্রয়োজন। কেহ যাহাতে এই ব্যাপারে দায় এড়াইতে না পারেন, এই জন্য প্রয়োজনে আইনটি সংশোধন করাও আবশ্যক।
পোস্টার-ফেস্টুন, ব্যানার প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশে যেইভাবে শহরের দৃষ্টিদূষণ ঘটিতেছে, তাহা মোটেও কাম্য নহে। তাই শহর-নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখিতে সকলকে সচেতন ও সুশৃঙ্খল হইতে হইবে। নিজের শহর মনে করিয়াই আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করিতে হইবে।

