ঘুষ দুর্নীতির আখড়া বিআরটিএ

Spread the love

জাহিদুল হক চন্দন

যানবাহনের রেজিষ্ট্রেশন,ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিআরটিএ’র প্রতিটি সেবা পেতে সেবাপ্রার্থীদের নির্ধারিত ফির বাইরে গুনতে হচ্ছে ঘুষ। বিআরটিএ অফিসের অসাধু কর্তা ব্যক্তিদের দূর্নীতির ফলে ঘুষের টাকা ছাড়া সেবা পেতে দিনের পর দিন সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দৈনিক টেলিগ্রামের অনুসন্ধানে বিআরটিএ’র জেলা কার্যালয়গুলোতে এমন অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর প্রতিবেদনেও সেবাখাতে বিআরটিএর দূর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে।

কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ কার্যালয়ের অফিস কর্মচারিরা দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। এ কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, উচ্চমান সহকারী সাকিরুল ইসলাম,মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট মো:ফারদিন খান, অফিস সহকারী মোয়েজ্জেম হোসেন ভূইয়া নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে। চলতি বছরে এ কার্যালয়ের অনিয়ম ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে ১৮ ফেব্রুয়ারি অভিযান পরিচালনা করে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই অভিযানে অফিস কর্তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও সেবাপ্রার্থীদের হয়রানিসহ একাধিক অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক । এমন অভিযানের পর কিছুদিন দালালদের আনাগোনা কমলেও আবারো তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অফিস কর্তাদের অহেতুক হয়রানির ফলে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। দুদকের ওই অভিযানের পর এক কর্মকর্তা ও কর্মচারিকে বদলি করে প্রশাসন। তারপরও নানা কৌশলে অফিসের দায়িত্বরতরা ঘুষ বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।

সেবাপ্রার্থীদের ভাষ্য, আগের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদের অনিয়ম,দূর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করার পর বদলি করা হলেও ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে কোন সুরাহা হয়নি।। দুদকের অভিযানের পরেও অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয়না। ফলে এখন আর কেউ অভিযোগ করেনা। হয়রানি এড়াতে বেশিরভাগ সেবাপ্রার্থী ঘুষ দিয়েই কাজ করেন।

উচ্চমান সহকারী সাকিরুল ইসলাম বলেন, যেদিন দুদকের অভিযান হয়ে ওইদিন আমি ছুটিতে ছিলাম। দুদকের অভিযানের পরেও অফিসে সেবা পেতে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,অফিসে সেবা প্রদানের পরিবেশ আগের চেয়ে ভালো।

মোটরযান পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন  বলেন, দুদকের অভিযানের পর সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ ও পিয়ন মাহফুজুর রহমানকে বদলি করে প্রশাসন। ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় পাশ করাতে দালাল চক্রের মাধ্যমে আপনিসহ অফিসের দায়িত্বরতরা ঘুষ নিয়ে থাকেন এমন প্রশ্নের মন্তব্য জানতে চাইলে সহকারী পরিচালকের সাথে কথা বলে মন্তব্য করবেন বলে জানান। পরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

পরে সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) কামরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,এ অফিসে কেউ কোন সেবা না পেলে আমার সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হয়েছে। কেউ কোন অভিযোগ করলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নারায়নগঞ্জ

নারায়নগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন অফিস কর্তা ব্যক্তিরা। তবে এ অফিসে অনুসন্ধানের সময় পাওয়া গেলো আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ অফিসের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিয়ার) মো: মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগ। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগও জমা পড়েছে।

ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, এ কর্মকর্তা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ২০১২ সালে বিআরটিএ বরিশাল অফিসে চাকরিতে যোগ দেন। পরে সাতক্ষীরা, খাগড়াছড়ি, কেরানীগঞ্জ, পিরোজপুর এবং ঝালকাঠিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ অফিসে কর্মরত থেকে অনিয়ম দুর্নীতি করে নিজ নামে এবং বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন। নিজের স্ত্রী এবং পিতা ও ভাইবোনদের নামেও সম্পদ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট এবং পিরোজপুর সদরের বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ রয়েছে।  ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করার সময় তার নাম ছিল মো. মাহবুবুল আলম। কিন্তু পরে তিনি বয়স কমিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হয়ে নাম পরিবর্তন করেন।

এ অফিসেরও সেবাপ্রার্থীদের সেবা পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অফিসের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবির,সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হেমায়েত হোসেন, উচ্চমান সহকারী জুবায়ের আহমেদ,মেকানিক্যাল এ্যাসিস্টেন্ট রকিবুর রহমান ভূইয়া,অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর শামীম রেজা,অফিস সহায়ক ফায়েজুর রহমানের সাথে দালালদের সখ্যতা রয়েছে। ফলে এদের কাছে কোন সেবাপ্রার্থীরা গেলে নানাভাবে হয়রানি করেন।

এ অফিসের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিয়ার) মো: মাহবুবুর রহমান বলেন, অফিস কর্তারা টুকটাক ভুলের কারনে সেবাপ্রার্থীকে ফেরত দেন কিন্তু দালালের মাধ্যমে আসলে কাজ করে দেন এমন বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। আর এমন ঘটনা ঘটার কথা না। অফিসের সবাই সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে ২০১৯ সালে একবার তদন্ত হয়েছে। পুনরায় আবারো অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়টি মিথ্যা,বানোয়াট।

রাজবাড়ী

রাজবাড়ী বিআরটিএ কার্যালয়ের ঘুষ বাণিজ্য পুরোটাই ওপেনে হয়ে থাকে। গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অফিসে নিয়মিত কর্মকর্তা না থাকায় অফিস স্টাফরা বেপরোয়াভাবে দূর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, অফিস সহায়ক গোলাম মোস্তফা ঘুষ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তার হাত ধরেই ঘুষের বন্টনের ভাগ চলে যায় কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে। এ কার্যালয়ে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার বোর্ডে। নিজ যোগ্যতাই সহজে পাশ করা সোনার হরিন হলেও ঘুষ দিলেই করা যায় পাশ। সেবাপ্রার্থীরা বলেন, ঘুষ না দিলে যে পরিমান অফিসে আসা যাওয়া করা লাগে তার চেয়ে ঘুষ দিয়ে সহজে পাশ করা ভালো। ভোগান্তি এড়াতে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীরা ঘুষ দিয়েই পাশ করেন।

ঘুষ বানিজ্য ও দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে জানতে চাইলে অফিস সহায়ক গোলাম মোস্তফা বলেন, আমি হেল্প ডেস্কে বসে সেবাপ্রার্থীদের সেবা দিয়ে থাকি। অনেকে মন মতো সেবা না পেয়ে অহেতুক অভিযোগ করে। দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন বা ঘুষ বানিজ্যের সাথে আমি জড়িত না।

ওই অফিসে মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন শরীয়তপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক মো:মেহেদী হাসান। তার আশকারাতেই মূলত এসব দূর্নীতির সুযোগ পেতো সবাই। জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ থেকে মেহেদী হাসান তার মূল দায়িত্ব শরীয়তপুরে কর্মরত আছেন । এ অনুসন্ধান চলাকালীন সময়ে রাজবাড়ি বিআরটিএতে নতুন মোটরযান পরিদর্শক যোগদান করেছেন। অনুসন্ধান বলছে, শরীয়তপুর বিআরটিএ অফিসেও রয়েছে মেহেদী হাসানের দালাল বাহিনী। এমন অভিযোগের পর ওই অফিসে দুদকের অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোটরযান পরিদর্শক মো:মেহেদী হাসানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোন উত্তর দেননি।

টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল বিআরটিএ অফিসে অফিস কর্তাদের রোষানলে পড়ে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে এ কার্যালয়ে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। অফিস কর্তাদের ক্ষমতার দাপটে কেউ কথা বলার সাহস পাননা। তবে গত বছরের ১১ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন অফিস কর্তারা। ছাত্ররা ঘুষ বাণিজ্য,দালাল সিন্ডিকেড নিয়ন্ত্রনসহ একাধিক অভিযোগ নিয়ে হাজির হোন ওই কার্যালয়ে। পড়ে অফিস কর্তাদের আশ্বাসে ওই ছাত্ররা ওই অফিস ত্যাগ করেন।

সেবাপ্রার্থীদের ভাষ্য, গত বছরের আগষ্ট মাসে সেবা পেতে তেমন হয়রানি হতে হয়নি। তারপর থেকে অফিস সেই আগের মেতো চিরচেনা রুপে ফিরেছে। নিজে কোন কাজ করতে গেলে নানা ভুল ধরা হয়। আর দালাল ধরে গেলে সব স্বস্তিতে করা যায়।

টাঙ্গাইলের সহকারী পরিচালক শেখ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, সকল নিয়ম কানুন মেনেই অফিস পরিচালিত হয়। অফিস কর্তাদের সাথে দালালদের কোন সম্পর্ক নেই। ছাত্ররা নানা অভিযোগ নিয়ে শুধু এই অফিসে আসেননি,অনেক অফিসেই গেছেন।

চাঁদপুর

চাঁদপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: আনোয়ার হোসেন চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে ঘুষ বাণিজ্যে আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। এ অনুসন্ধানকালীন সময়ে ৩০ জানুয়ারি তিনি অবসরে গেছেন। তবে অবসরে যাওয়ার আগে রেখে গেছেন দুর্নীতির নানা চিত্র। অনুসন্ধান বলছে, দালালদের সাথে সরাসরি সখ্যতা গড়ে তুলেছেন তিনি। শহিদ,মাস্টার রোলের শাওন, আলী,আমিনুলসহ একাধিক দালাল চক্রের আনাগোনা রয়েছে এ অফিসে। সম্প্রতি দালালদের উৎপাত ও ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ছাত্ররা হাতেনাতে দুইজন দালালকে ধরে পুলিশে দেন। তারপরও এ কার্যালয়ে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। অফিস বরাদ্দের বিভিন্ন খাতের টাকা ভুয়া বিলের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন সহকারী পরিচালক। তার এ বিল ভাউচার তৈরিতে সহায়তা করেছেন মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট মো:শামীম মিয়া। তবে ভূয়া বিল ভাউচার তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শামীম মিয়া। এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাঁদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো: আনোয়ার হোসেনের সরকারি নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। তার ব্যক্তিগত দুটি নাম্বারে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষুদেবার্তায় সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন লিখে পাঠানো হলেও কোন উত্তর দেননি।

সার্বিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিআরটিএর অফিসেগুলোতে সেবা পেতে যে হয়রানি হতে হয় তার কোন সুরাহা কর্তৃপক্ষ করেন না। যারা ঘুষ বাণিজ্য,দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করেন তাদের বলার মতো কোন শাস্তি হয়না। ফলে এ সেবাখাতটি দিন দিন অনিয়মের খাতে পরিনত হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত। বিআরটিএর দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মো: ইয়াসিন বলেন, অফিস দালাল মুক্ত রাখতে অফিসিয়ালি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেবাপ্রার্থীরা কেউ যেনো ভোগান্তির শিকার না হয় সে বিষয়ে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। কেউ অনিয়মের সাথে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Scroll to Top