মঙ্গলবার

২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এক সর্বজনীন সত্যের নিদারুণ বাস্তবতা

প্রবাদে আছে, ‘অহংকার পতনের মূল’। এই বাক্যটি আমরা মুখে অহরহ আওড়াই; কিন্তু বাস্তবের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অহংকার কীভাবে সর্বনাশ ডাকিয়া আনে, তাহার অজস্র দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব কমই তাহা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া থাকি। অহংকার এমন এক আত্মিক ব্যাধি যাহা মানুষকে অন্ধ করিয়া তোলে, যাহার অনিবার্য পরিণতি হইল অধঃপতন। এই সংক্রান্ত আরেকটি প্রবাদ রহিয়াছে যাহা মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল ও নির্যাস। যেমন-‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’। অতিশয় অহংকার বা দম্ভের কারণে লঙ্কাধিপতি রাবণের মতো পরাক্রমশালী রাজারও পতন হয়।
অহংকার ও পতন হাত ধরাধরি করিয়া চলে বিধায় প্রায় সকল ধর্মেই অহংকারকে গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে। ইসলাম ধর্মে অহংকারকে ‘উম্মুল আমরায’ বা সকল পাপের জননী বলা হইয়াছে। প্রথম সৃষ্টিগত পাপই হইল ইবলিশ শয়তানের অহংকার। পবিত্র কোরআনে বলা হইয়াছে: “আর যখন আমি ফেরেশতাদের বলিলাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা করো’, তখন ইবলিস ছাড়া সকলেই সিজদা করিল। সে শুধু অহংকারবশত সিজদা করিতে অস্বীকার করিল। আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেল।” (সুরা বাকারা: ৩৪) আবার বলা হইয়াছে, ‘মানুষের দিক হইতে মুখ ঘুরাইয়া রাখিয়া কথা বলিও না এবং পৃথিবীতে গর্বের সহিত চলিবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বড়াইকারী ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান: ১৮) এই জন্য রসুলুল্লাহ (স.) বলিয়াছেন, ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করিবে না, যাহার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রহিয়াছে। তখন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করিল, লোকেরা চায় যে, তাহাদের পোশাক সুন্দর হউক, জুতা জোড়া সুন্দর হউক। জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হইল সত্যকে দম্ভের সহিত পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।’ (সহিহ মুসলিম: ৯১)। এইখানে অহংকারের সংজ্ঞা চমৎকারভাবে তুলিয়া ধরা হইয়াছে। কোনো অপরাধ বা ভুল করিয়াও ক্ষমা না চাওয়াটাও অহংকারের মধ্যেই পড়ে।
খ্রিষ্টধর্মগ্রন্থ বাইবেলের হিতোপদেশ (Proverbs) গ্রন্থে অহংকারের পরিণতি সম্পর্কে বলা হইয়াছে: ‘অহংকার আসিলে অপমানও আইসে; কিন্তু প্রজ্ঞাই নম্রদিগের সহচরী।’ (হিতোপদেশ ১১: ২) অর্থাৎ অহংকার স্রষ্টার অসন্তোষ ও চূড়ান্ত লাঞ্ছনার কারণ। প্রাচীন মিশরের স্বৈরাচারী শাসক ফিরআউন (Pharaoh) ছিল চরম অহংকারী। তাহার দাম্ভিকতার কারণে আল্লাহ তাহাকে ও তাহার সৈন্যদলকে নীল নদে ডুবাইয়া ধ্বংস করেন। পরাক্রমশালী ও অহংকারী শাসক নমরুদের পরিণতি হইয়াছিল আরো করুণ। তাহার পতন হইয়াছিল সামান্য মশার কামড়ে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ অনুসারে, লঙ্কার রাজা রাবণ ছিলেন মহাজ্ঞানী ও শিবের ভক্ত; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি নিজের শক্তি ও ঐশ্বর্যের অহংকারে সীতাকে হরণ করেন এবং রামের হাতে সপরিবারে ধ্বংস হন। এইদিকে টাইটানিক জাহাজটির নির্মাতারা এত অধিক অহংকারী ছিলেন যে, তাহারা ইহাকে আনসিংক্যাবল বা অডুবন্ত তকমা দিয়াছিলেন। এই দম্ভের কারণে তাহারা পর্যাপ্ত লাইফবোট রাখা বা সতর্কবার্তা গুরুত্ব সহকারে নিতে ব্যর্থ হয়, যাহার করুণ পরিণতি হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ জাহাজডুবির মাধ্যমে।
আসলে অহংকার এমন এক আত্মিক অন্ধত্ব, যাহা মানুষকে তাহার ভুলগুলো দেখিতে দেয় না। অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে সঠিক মনে করিয়া অন্যের হিতোপদেশকে তুচ্ছতাচ্ছল্য করে। ফলে ভুল পথে চলিতে শুরু করে। এই জন্য ব্যক্তিগত হউক বা রাষ্ট্রীয়, যেখানেই অহংকার তাহার বিষাক্ত ডালপালা বিস্তার করে, সেখানেই নামিয়া আসে বিপর্যয়। অতএব, আমাদের উচিত প্রবাদ-প্রবচন, ইতিহাস ও ধর্মীয় বাণী হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং অহংকারমুক্ত বিনয়ী জীবন যাপন করা।

এ বিভাগের আরও সংবাদ

spot_img

সর্বশেষ সংবাদ