মঙ্গলবার

২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে নির্বাচন একসময় ছিল একধরণের সামাজিক উৎসব। সেই উৎসবে ছিল অংশগ্রহণের আনন্দ, ছিল একরকম ঈদের আমেজ। গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে, রাজনৈতিক দলগুলো শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামত না, মানুষকে নিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশও তৈরি করত। নির্বাচনি মিছিল মানেই ছিল উচ্ছ্বাস, গান, পোস্টার লাগানো, চায়ের দোকানে উত্তপ্ত আলোচনা, আর সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা রকম আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই উৎসব-আনন্দ যেন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ভয়, দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস এবং ব্যাপক অনিয়মের স্মৃতি। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচনি পরিবেশ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, মানুষ নির্বাচনকে আর উৎসব মনে করত না; বরং অনেকেই নির্বাচনের দিন ঘর থেকে বের হতে ভয় পেত। কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি, বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা-এসব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই গণআন্দোলনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা নতুন করে একটা আশার আলো দেখিয়েছে। অনিয়ম আর ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের পর মানুষ একধরনের মুক্তি অনুভব করেছে। সেই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবর্তন এসেছে, আর সেই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের মনে ফিরে এসেছে সেই পুরোনো নির্বাচনি উৎসবের স্মৃতি, সেই প্রত্যাশা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটিকে ঘিরে তাই নতুন এক সম্ভাবনার কথা ভাবা যায়। মানুষ আবার বিশ্বাস করতে চাইছে, নির্বাচন সত্যিই তাদের ভোটে, তাদের অংশগ্রহণেই নির্ধারিত হবে।
তবে আশাবাদের পাশাপাশি বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না। বছরের পর বছর ধরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব অনিয়ম আর সহিংসতা হয়েছে, তা রাতারাতি দূর হয়ে যাবে এমন ভাবা ভুল হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের সংস্কৃতি, সন্ত্রাসীদের ব্যবহার, প্রশাসনকে দলীয়করণ-এসবের ছাপ এখনো সমাজে রয়ে গেছে। ফলে যদি আবার উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, তাহলে তার জন্য প্রয়োজন কঠোর, সতর্ক এবং সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং সেখানেই আসে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশ্ন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ইতিহাসগতভাবেই দেশের সংকটময় মুহূর্তে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে জাতীয় জরুরি মুহূর্ত-এমন সব ক্ষেত্রেই তাদের উপস্থিতি মানুষের মনে আস্থা জাগায়। নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একই বিষয় সত্য। সেনাসদস্যদের প্রতি মানুষের আস্থার মাত্রা সব সময়ই বেশি। জনমনে এমন ধারণা রয়েছে যে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট নিয়ে কারচুপি, দখলদারিত্ব বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে যায়।
বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এখনো রাজনৈতিক সহিংসতার শঙ্কা আছে। দলীয় সন্ত্রাস দীর্ঘদিন ধরে প্রতিপক্ষকে দমানোর এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি কিছু এলাকায় অস্ত্রধারী ভাড়া-করা বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্বাচনকে আবার উৎসবমুখর করতে হলে এসব অনিয়ম, ভয়ভীতি এবং সন্ত্রাস থেকে ভোটারদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে হবে। এই জায়গাটিতেই সেনাবাহিনী সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে।
সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চোখে এখনো একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনকালে তাদের উপস্থিতি ভোটারদের মনে নিরাপত্তা তৈরি করে। অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে কেন্দ্র দখল বা জোরজবরদস্তি করার ঘটনা কমে যায়। কিছু অঞ্চলে যেসব সহিংস গোষ্ঠী সক্রিয়-তাদের নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি খুবই কার্যকর। পুলিশ বা বিজিবির তুলনায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সন্ত্রাসীদের মনোভাবে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। নির্বাচনি সহিংসতা হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেনাবাহিনীর দ্রুত প্রতিক্রিয়া, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত উপযোগী। অতীতে দেখা গেছে-স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ কখনো কখনো ক্ষমতাসীন দলের চাপে নিরপেক্ষতা হারায়। সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে প্রশাসনের মধ্যেও দায়িত্বশীলতা বাড়ে। যখন ভোটাররা ভরসা পায় যে, ভোটকেন্দ্রে কোনো অনিয়ম হবে না, তাদের বিরুদ্ধে কেউ ভয়ভীতি দেখাবে না, তখন ভোটার উপস্থিতিও বাড়ে। আর এই অংশগ্রহণই নির্বাচনি উৎসবকে পূর্ণতা দেয়।
অনেকেই বলেন-নির্বাচনকে কেন ‘উৎসব’ বলা হয়? কারণ নির্বাচন শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং নাগরিকদের ক্ষমতার প্রকাশ। তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করবে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব বেছে নেবে। এই প্রক্রিয়াটাই গণতন্ত্রকে জীবন্ত রাখে। আর যখন মানুষ পরিবার-বন্ধু-প্রতিবেশীনিয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়, যখন চায়ের দোকানে উত্তপ্ত বিতর্ক চলে, যখন দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার আর ব্যানারে ভরে যায়, তখন সেটাই একধরনের সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। কিন্তু এই উৎসব তখনই সম্ভব, যখন থাকবে নিরাপত্তা, থাকবে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, থাকবে প্রতিযোগিতা।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটায়নি, এটি মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। ঐ আন্দোলন দেখিয়েছে, মানুষ চাইলে অন্যায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আর যখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তাদের ভোট সত্যিই মূল্যবান, তখনই তারা নির্বাচনি উৎসবের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তবে যেহেতু অতীতের রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষত এখনো পুরোপুরি শুকায়নি, তাই এই আস্থা টিকিয়ে রাখতে নিরাপত্তার শক্তিশালী কাঠামো দরকার।
সেনাবাহিনীকে সরাসরি ভোটকেন্দ্র পরিচালনায় যুক্ত করার কথা নয়। বরং তাদের উপস্থিতি থাকবে সতর্কতামূলকভাবে-সহিংসতা রোধ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দমন, সংবেদনশীল এলাকায় টহল ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার কাজে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনকে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি পরিষ্কার নির্দেশনা দিতে হবে, যাতে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করতে পারে নিরপেক্ষভাবে, স্বচ্ছভাবে।
সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, ক্লাব, বিজিবি-সবার ভূমিকা প্রয়োজন। তবে সেনাবাহিনী যেন থাকে ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে, যার উপস্থিতিই সন্ত্রাসীদের মনে ভয় তৈরি করবে, ভোটারদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
আগামী নির্বাচনের সামনে দেশের রাজনীতি একধরনের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। বহু বছর পর এবার এমন একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এবার স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার কথা বলছে। মানুষও অপেক্ষা করছে আবার সেই চিরচেনা গ্রামীণ মিছিল, লিফলেট বিলানো, উঠোন-বৈঠক, তরুণদের প্রচার, আর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাসি-আনন্দে ভরা পরিবেশের। এই প্রত্যাশাকে সত্যি করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হতে হবে আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। শুধু ভোটের দিনই নয়, ভোটের আগের দুই-তিন সপ্তাহেও সেনাবাহিনীকে নিয়মিত টহলে রাখতে হবে, যাতে সন্ত্রাসীরা মাথা তুলতে না পারে। পাশাপাশি ভোটের পর ফলাফল ঘোষণার সময়ও উত্তেজনা এড়াতে সেনাবাহিনী
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে বলব-উৎসবমুখর নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অংশ ছিল। সেই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, নিরাপত্তা এবং সুশাসনও জরুরি। সেনাবাহিনী সেই নিরাপত্তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন। তাদের উপস্থিতি শুধু ভোটারদের আস্থা বাড়াবে না, বরং একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশও তৈরি করবে।
বাংলাদেশের মানুষ আবার সেই পুরোনো নির্বাচনি উৎসব দেখতে চায়। চায় হাসিমুখে ভোট দিতে যেতে, চায় নিজের মত প্রকাশ করতে। আর সেই পথ তৈরি করতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াবে। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন তাই শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের সামাজিক বন্ধনের পুনর্জাগরণের এক সম্ভাবনা। সঠিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কার্যকর ভূমিকা-এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।

এ বিভাগের আরও সংবাদ

spot_img

সর্বশেষ সংবাদ