পবিত্র কুরআনের আলোকে রাসুলে পাকের (সাঃ) এর শান,লাইলাতুল মিরাজ ও তাৎপর্য

Spread the love

আম্মা বা’আদ,

পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত সম্মানিত চারটি মাসের একটি রজব মাস।এই মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে সংঘটিত হয়েছিল এক মহাপবিত্র ঐশ্বরিক ঘটনা। এই রাতটি সর্বস্তরে সুপরিচিত “লাইলাতুল মেরাজ” নামে। আরবি ‘লাইল’ শব্দের অর্থ ‘রাত্রি,রজনী’ আর “মেরাজ” শব্দের অর্থ ‘ঊর্ধলোকে গমন’। মেরাজ শব্দটি ‘আরাজা’ শব্দ থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ ‘আরোহন করেছিলো’। এখানে আত্মিক আরোহন বুঝানো হয়েছে তাই, মেরাজ শব্দটির পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায়-”আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও উচ্চমর্যাদা প্রাপ্তির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য  লাভের লক্ষ্যে ঊর্ধ্বলোকে আত্মিক আরোহন”। ভারতীয় উপমহাদেশে এই রজনীকে “শব-ই-মেরাজ” হিসেবেই বেশিরভাগ আখ্যায়িত করা হয়। এ রাত্রি হল “মাশুক”র সাথে “আশিক”র মোলাকাতের রজনী।

এখানে মাশুক বা প্রেমময় ছিলেন স্বয়ং রাব্বে জুল জালাল আর তাঁর পবিত্র প্রেমিক বা আশিক ছিলেন রাসূলে করীম পাক (সাঃ)। সেই পবিত্র রজনীতে রাব্বুল আলামিনের পরম আহবানে সাড়া দিতে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমান সমূহে পরিভ্রমণ করেছিলেন রহমাতুল্লিল আলামিন, উম্মতের শাফায়াতকারী, হাবিবুন আওলা, মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)। পবিত্র কোরআনে “মেরাজ” শব্দটির সরাসরি উল্লেখ নেই বরং সেখানে বলা হয়েছে “ইসরা”। যার অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ, নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।সূরা আল-ইসরা যা সূরা বনি ইসরাইল নামে পরিচিত; এর প্রথম আয়াতেই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন—”পবিত্র মহান সে সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করালেন আল মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশেপাশে আমরা দিয়েছি বরকত যেন আমরা তাঁকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি; তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা!”

এই সফর ছিল আলম-ই-মুলক থেকে আলম-ই-মালাকুত,আলম-ই-জাবারুত ও আলম-ই-লাহুত পর্যন্ত। “আলম” বা জ্ঞান; এই জ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ লাভ হয়েছিল মেরাজে। এই সফরে মিলিত হয়েছিলেন “নূর” ও “নুর”। একটু ব্যাখ্যা করছি বিষয়টি—

মালিকি ইয়াওমিদ্দিন রাব্বে জুলজালালী ওয়াল ইকরাম স্বীয় জাতের একখণ্ড নূরকে পাঁচটি খন্ডে বিভক্ত করেন এবং পরবর্তীতে সেই পাঁচ খণ্ড নুর হতেই কুল মাখলুকাত সৃষ্টি করেন। নিজ নূরের খন্ডিত ৫টি অংশের প্রথম অংশটি দ্বারা তিনি পয়দা করেন তাঁর হাবীব আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামকে। আর এই কর্ম সম্পাদিত হয়েছিলো দুনিয়া সৃষ্টিরও সহস্রাধিক বর্ষ পূর্বে!

অতঃপর যখন দুনিয়াতে আত্মপ্রকাশের সময় এলো তখন রাব্বুল আলামিন তাঁকে দান করলেন “বাশারী রূপ বা মনুষ্য আকৃতি।” তাঁকে সৃষ্টি নয় বরং পয়দা করা হয়েছিল আর তাঁকে রব নির্ধারণ করেন নিজ মোহাব্বাতের বিকাশস্থল হিসেবে। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর হাবিব মোস্তফা (সাঃ) কে মোহাব্বত করেন, তাজিম করেন, সানা-সিফাত বর্ণনা করেন আর ঊর্ধ্বলোকের ফেরেশতাদের দ্বারাও এই কর্মগুলো সম্পাদন করান। সেই সাথে সকল সৃষ্টি তথা ১৮ হাজার মাখলুককে আদেশ দিয়েছেন রাসূল পাকের প্রতি মুয়াদ্দাত,

তাজিম,সালাওয়াত প্রেরণ করার। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ সালাত (দরূদ) পাঠ করছেন রাসুলের ওপর ও তাঁর প্রতি পেশ করছেন সালাম! অতএব হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তদ্রুপ তাঁর প্রতি সালাত পাঠাও ও তাঁকে পেশ করো সালামের মত সালাম!”-সূরা আহযাব,৫৬

এই আয়াত নাজিলের দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন “মালা-উল-আলা বা ঊর্ধ্ব জগতে” রাসুলে পাক (সাঃ) এর শান প্রকাশের মাধ্যমে আদেশ দিলেন যেনো ঊর্ধ্বলোক ও অধঃলোকে রাসুলের গুণবন্দনায় মুখরিত থাকে সবসময়।

সুবাহানাল্লাহ!

মহিমান্বিত রব নিজ নুরকে বাশারী হালতে দুনিয়াতে প্রেরণের দীর্ঘ কিছু বছর পর ইচ্ছে করলেন নিজ রূপে তাঁর সাথে বিলীন হয়ে যাওয়ার আর তাই উক্ত পবিত্র রজনীতে প্রিয় হাবিব কে ইসরার মাধ্যমে মেরাজ করালেন।

নবুয়তের দশম বছরে ৬২১ খ্রিস্টাব্দে রাসূলে কারীম পাক (সাঃ) তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানি (আঃ) এর গৃহে বিশ্রামরত ছিলেন। এসময় গৃহটির উপরের অংশ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং রুহুল কুদ্দুস হযরত জিব্রাইল আমিন (আঃ) সেখানে প্রবেশ করেন হযরত মিকাইল (আঃ) ও ৫০হাজার ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে। সকলে সে সময় দরুদ পাঠরত অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা প্রথমে সালাম পেশ করেন এবং জিব্রাইল (আঃ) ফরমালেন- “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আসমান সমূহ সুসজ্জিত করা হয়েছে কারণ সুমহান রব ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন আপনার সাথে মোলাকাতের!”

অতঃপর সম্পূর্ণ জাগ্রত হালতে শুরু হলো আত্মিক এ সফর। প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ‘ইসরা’ সম্পন্ন হলো এবং শুরু হলো ‘মেরাজ’। বাহন ছিল “বোরাক” নামক এক বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন প্রাণী।

হযরত জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসে ঝুলন্ত “ছখরা” নামক প্রস্থরের কাছে নিলেন আর সেটি থেকে আসমান পর্যন্ত একটি সোপান আবির্ভূত হলো। এর ডান ও বামপার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধভাবে ফেরেশতাকুল দন্ডমান হলেন আর বোরাকে আসীন “রহমাতুল্লিল আলামীন” সোপান বেয়ে এগিয়ে চললেন। কয়েক লক্ষ কোটি ফেরেশতার সালাম গ্রহণ করে তিনি “বাবুল ছাফাযা” অতিক্রম করে অবলোকন করেন উপবিষ্ট হযরত আদম (আঃ) কে। তিনি স্বয়ং সালাম জানান রাসূলে পাক (সাঃ) কে- “শান্তি বর্ষিত হোক আপনার উপর, হে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান!”

এরপর ধাপে ধাপে বহু নবী-রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ, সপ্ত আসমান-জমিনের সকল নিদর্শন অবলোকন, হক-বাতিলের পার্থক্য নিরূপণ,সৃষ্টির শুরু হতে অধ্যাবধি সকল ঘটনার পর্যবেক্ষণ, বিচার দিবসের কারণ-পরিণাম-পরবর্তী বিধান প্রাপ্তি শেষে তাঁর সামনে উন্মোচিত করে দেয়া  হলো আইন-উল- ইয়াকিন ও হাক্ব-উল- ইয়াকিন অর্থাৎ সৃষ্টি ও স্রষ্টার নিগুঢ় সত্যের রহস্য! এরপর তিনি অতিক্রম করলেন “বাইতুল মামুর”; অতঃপর পৌঁছালেন “সিদরাতুল মুনতাহা”য়। অবতারণা হলো অপূর্ব এক দৃশ্যের! রাহমাতুল্লাহি আল আমিনকে ভূষিত করা হলো—”সাইয়েদুল মুরসালিন, ইমামুল মুত্তাকিন ও কায়েমুল গোররিল মুহাজ্জলীন” এই তিন উপাধিতে এবং অগণিত ফেরেশতাকুল তাঁকে এক নজর দেখার জন্য ও তাঁর বরকত প্রাপ্তির জন্য আচ্ছাদন করে ফেললো সিদরাতুল মুনতাহা ও তাঁকে জিয়ারত করতে লাগলো বাইতুল মামুর এর অনুরূপ। অতঃপর শাহ্-এ-কাওনাইন অতিক্রম করলেন মুনতাহাকে এবং আরো উর্ধ্বে আরোহণ করে পৌঁছলেন এক সোনালী পর্দার নিকট।

এটি ছিলো হুজুর-ই-আজমতের প্রথম পর্দা। পর্দার অন্তরালে থাকা ফেরেশতা পর্দা সঞ্চালন করে সালাম জানান সুলতান-ই-দারাইন হাবীবাল্লাহর প্রতি। রুহুল কুদ্দুস জিব্রাইল থেমে গেলেন এই স্তরে কেননা, আর এগোনোর অনুমতি তাঁর নেই। উক্ত ফেরেশতা রাসূলকে পৌঁছে দিলেন পরবর্তী পর্দার ফেরেশতার নিকট এবং এভাবে তিনি অতিক্রম করলেন ৭০ হাজার নূরের পর্দা! প্রতিটি পর্দার সাথে ছিলো একটি করে অন্ধকারের পর্দা; অর্থাৎ তিনি ৭০ হাজার নূর বা ঈমানের হাকিকত ও সত্তর হাজার কুফরের হাকিকতের  পর্দা ভেদ করেন। প্রতিটি পর্দার ব্যবধান ও পুরুত্ব উভয়ই ছিল ৫ শত বছর করে! অবশেষে তিনি উপনীত হলেন শেষ পর্দায় আর উচ্চারণ করলেন-

“আল্লাহু আকবার,আল্লাহু আকবার”

অন্তরাল থেকে উত্তর এলো- “আনা আকবারু, আনা আকবারু”

এরপর চলল সাক্ষ্যদান ও গ্রহণ। অবশেষে আল্লাহ জাল্লা শানুহু থেকে ইরশাদ এলো, “হে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক, নিকটবর্তী হও; হে আহমাদ, নিকটবর্তী হও; হে মুহাম্মদ, নিকটবর্তী হও; হে হাবিব আমার, নিকটবর্তী হও!” এ কথা তিনি এক হাজার বার উচ্চারণ করেন। একসময় তিনি স্বয়ং, নিজ হাবীবের নিকটবর্তী হন! এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ হয়েছে- “অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হন, আরো নিকটবর্তী! ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা আরো কম!”- (সূরা আর নাজম,৮-৯)

অতঃপর নূর-এ-খোদা আরো নিকটবর্তী হন স্বীয় নূরের মালিকের আর সেজদায় পতিত হন। অতঃপর পেশ করলেন- “আত্তাহিয়াতু লিল্লাহে ওয়াসসালাওয়াতু ওয়াত্তায়্যিবাত”

উত্তরে সুমহান প্রতিপালক দান করলেন সালাম- “আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”

রাহমাতুল্লাহি আলামিন এই সালামটি শুধু নিজের জন্য নয় বরং সকল উম্মতকেও নিজের সাথে শামিল করে গ্রহণ করলেন! আরশে মোয়াল্লা নূরে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো আর উম্মতের নাজাতকারীর দানশীলতা ও মহানুভবতা দর্শন করে ফেরেশতাকুল আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পেশ করলেন সাক্ষ্য- “আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু” রাব্বে জুলজালাল এরশাদ করেন- “হে মুহাম্মদ! আমি আর তুমি, এই ছাড়া আর যত কিছু আছে, সবই সৃষ্টি করলাম তোমার কারনে!”

রাসুলে পাক ফরমালেন- “হে পরওয়ারদিগার! আমি ও আপনি এছাড়া, আর যত কিছু আছে সব পরিহার করলাম আপনার কারণে!”অতঃপর সমস্ত মানবসম্প্রদায়ের কল্যাণের তরে সকল বিধি-বিধান গ্রহণ করে ফরাশে প্রত্যাবর্তন করেন  খায়ের-উল-ওয়ারা, নুর-উল-উলা, শামস-উদ-দুহা, বদর-উদ-দোজা মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)।

অতি পবিত্র এই রাতটিতে প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর জন্য ইবাদত, বন্দেগী, দরুদ,সালাত, জিকর অবশ্য কর্তব্য। এ রাতকে

অস্বীকারকারীগণ গোমরাহী ও বরবাদীতে পতিত হবে। ফিকহে আকবারে উল্লেখ হয়েছে- “এবং মেরাজের খবর সত্য! যে ওই খবরকে অস্বীকার করে সে গুমরাহ ও বিদ’আতী”

“এ হলো মহাপবিত্র গ্রন্থ কুরআন যাতে রয়েছে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও জ্ঞানীদের জন্য পথনির্দেশনা; যদি তারা তা বুঝতে পারে!”- আল কুরআন

রব্বুল আলামীন আমাদের “সিরাতাল মুস্তাকিম”এ দাখিল রাখুন!

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মোহাম্মদ।।

লেখক,

দিজা মাহজাবিন হকমহিলা বিষয়ক সম্পাদক,

“পাক পাঞ্জাতন অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ”

Scroll to Top